যানজট ও হকারমুক্ত নারায়ণগঞ্জ’ গড়তে আইভী-সেলিম-শামীম একত্রে
রাজনৈতিক বিভক্তির কারণে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য একেএম সেলিম ওসমান ও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমানকে কদাচিৎ একমঞ্চে দেখা যায়।
তারা তিনজনই শহরের প্রধান দুই সমস্যা—যানজট ও হকার—সমাধানে ঐক্যবদ্ধ থাকার ঘোষণা দিয়েছেন।
বৈঠকে উপস্থিত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক ও জেলা পুলিশ সুপার (ভারপ্রাপ্ত) আমীর খসরুও এ ব্যাপারে কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন।
বৈঠকের শুরুতে শহরের যানজট ও ফুটপাতের হকার সমস্যা নিয়ে নির্মিত একটি ভিডিওচিত্র দেখানো হয়।
নাসিক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, ‘৪০০ বছরের পুরনো আমাদের নারায়ণগঞ্জ শহর। কোলকাতা শহরের আগে বন্দর নগরী দিয়ে এ শহরের গোড়াপত্তন হয়েছে। ব্রিটিশরা এখানে এসেছে পাটসহ বিভিন্ন ব্যবসা ছিল। তখন এটা ছিল পজিটিভ নারায়ণগঞ্জ। আমরা সেই পজিটিভ নারায়ণগঞ্জ চাই। শামীম ভাই অনেকদিন পরে হলেও একমত হয়েছেন যে ফুটপাত হকারমুক্ত করতে হবে, যানজট নিরসন করতে হবে। এর থেকে পজিটিভ দিক আর হতে পারে না।’
সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘সড়কের অবৈধ স্ট্যান্ডগুলো বন্ধ এবং রুট পারমিট ছাড়া যেন সড়কে কোনো বাস চলতে না পারে সে ব্যাপারে প্রশাসনকেই উদ্যোগ নিতে হবে। ট্রাকের নগরী হিসেবে নারায়ণগঞ্জকে আমরা চাই না। আপনারা সরকারি কর্মকর্তা, আপনারা দলাদলি দেখবেন না। আপনাদের নিয়ম অনুযায়ী কাজ করবেন।’
শামীম ওসমানকে উদ্দেশ্যে করে মেয়র বলেন, ‘ভাই, আপনি যদি ঘোষণা দেন তাহলেই হবে। পুলিশকে আপনি বাধ্য করবেন। আপনি সংসদ সদস্য। আপনাদের কথায় পুলিশ, প্রশাসন চলে, মেয়রের কথা তারা শোনে না। এসপি-ডিসি আমারে পাত্তাই দেয় না। তাদের অনুরোধ করে আমার নিতে হয়।’
২০১৮ সালে হকার ইস্যুকে কেন্দ্র করে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে মেয়র আইভীসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হন। তবে হকারমুক্ত ফুটপাতের বিষয়টি এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি।
এই প্রসঙ্গে আইভী বলেন, ‘৬০০ হকারকে পুনর্বাসন সিটি করপোরেশন করেছে। তারা দোকানগুলো বিক্রি করে দিয়ে আবারও ফুটপাতে চলে এসেছে। সড়ক ও ফুটপাতের মালিক নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন। অন্যরা খবরদারি করে হকার বসিয়ে টাকা তোলে, এখানে প্রশাসনেরও কিছু লোক রয়েছে। ২০১৮ সালে এ হকার ইস্যুতে যে ভুল বোঝাবুঝি আমার আর শামীম ভাইয়ের মধ্যে হয়েছে তাতে অনেকেই সুবিধা নিয়েছেন। সে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হোক। আজ আমরা একমত হয়েছি। এই শহর সুন্দর নগরী হোক।’
সিটি মেয়রের এই বক্তব্যের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান ও শামীম ওসমানও বলেন, তারাও শহরের সড়কগুলো যানজটমুক্ত ও ফুটপাতগুলো হকারমুক্ত চান। তারা জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপারকে এই ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে তাগিদ দেন।
শামীম ওসমান বলেন, ‘আমরা ভালো কাজগুলো একসঙ্গে করবো। শুধু একটি সড়ক হকারমুক্ত করলে হবে না, করলে সবগুলো সড়কই হকারমুক্ত করতে হবে। কোনো যানবাহন রুট পারমিট ছাড়া চলতে পারবে না। এটার ব্যবস্থা বিআরটিএ নেবে। আমার পক্ষ থেকে কোনো প্রকার বাধা থাকবে না, সকলের ক্ষেত্রেও যেন তাই হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিআরটিএ প্রয়োজনের অতিরিক্ত গাড়ির পারমিশন দেবে না। আর সেক্ষেত্রে আমাদের নারায়ণগঞ্জের পরিবহন ব্যবসায়ীদের আগে মূল্যায়ন করা উচিত। অবৈধ স্ট্যান্ড উচ্ছেদ করে নির্দিষ্ট স্থানে স্ট্যান্ড দিতে হবে। আর অবৈধ স্ট্যান্ডে কেউ না কেউ টাকা তোলে। সেই ব্যাপারেও খোঁজ নিতে হবে। আর যানজট কমাতে ট্রেন লাইন চাষাঢ়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।’
আদমজীতে ইপিজেডের কারখানাগুলো ছুটি হলে সেখানে প্রতিদিন যানজট দেখা দেয় উল্লেখ করে এই সংসদ সদস্য বলেন, ‘এই স্থানে একটা ফুটওভার ব্রিজ করার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। আমি আর আইভী একটা কাগজে সই করে পাঠালেও এটা সমাধান হয়ে যাবে।’
সেলিম ওসমান বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জে সমস্যার শেষ নেই। আজকে আমরা উঠে গেলাম আর সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এমনটা নয়। রাস্তার দায়িত্ব ট্রাফিক পুলিশের হাতে। ফুটপাত কার হাতে? এটা কি মাসলম্যানদের হাতে? এই দখলকারীরা কারা? এদের চিহ্নিত করতে হবে। আমরা একত্রিত থাকলে একটা ফুটপাতও দখলে থাকবে না।’
‘এখানে কোনো রাজনীতি থাকবে না। রাজনীতি একটাই, নারায়ণগঞ্জের মানুষকে শান্তিতে চলাচল করতে দিতে হবে। আমরা মেয়রকে অবশ্যই সহযোগিতা করব। আগামী এক বছরের মধ্যে আমরা নারায়ণগঞ্জে কোনো সমস্যা রাখব না। আমার মেয়র আইভীকে নিয়ে আমার ছোটভাই শামীম ওসমানকে নিয়ে আমরা এটা করব’, যোগ করেন তিনি।
মেয়র ও দুই সংসদ সদস্যের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে জেলা প্রশাসক মাহমুদুল হক বলেন, শহরকে যানজটমুক্ত করার ব্যাপারে আগামীকাল রোববার থেকে কাজ শুরু হয়ে যাবে।
‘প্রত্যেকে পজিটিভ নারায়ণগঞ্জ চাচ্ছেন। আপনাদের কথায় আমি সাহস পাচ্ছি। আমি এরকম একটি ঐক্যমত চাচ্ছিলাম। নারায়ণগঞ্জে রুট পারমিট ছাড়া কোনো গাড়ি চলবে না। সড়কের পরিমাপ অনুযায়ী সড়কে যানবাহন চলবে। এ নিয়ে আমরা কাজ করছি। গত ৫ মাসে সাড়ে ৪৫০ যানবাহনে জরিমানা করা হয়েছে। আগামীকাল থেকে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট সড়কে থাকবে। অবৈধ স্ট্যান্ডের বিরুদ্ধে অভিযান চালাবো। কোন অবৈধ স্ট্যান্ড থাকবে না।’
এই বৈঠকের সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে জেলা পুলিশ সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে বলে জানান জেলা পুলিশ সুপার (ভারপ্রাপ্ত) আমীর খসরু।
তিনি বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের জনপ্রতিনিধিরা ঐক্যমতের ভিত্তিতে যে সিদ্ধান্ত দিবে আমরা সেটি দ্রুত বাস্তবায়নের সর্বোচ্চ সহায়তা করবো।’
দুপুর ১২টায় শুরু হওয়া এই বৈঠক চলে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত। এতে সভাপতিত্ব করেন নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি আরিফ আলম দিপু এবং সঞ্চালনা করেন ক্লাবের কার্যকরী সদস্য আফজাল হোসেন পন্টি।
এ সময় জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান চন্দন শীল, নাসিকের কাউন্সিলর, ইউপি চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী নেতারা উপস্থিত ছিলেন।