মর্গ্যান স্কুল ছাত্রী নিতুর পরীক্ষা ও পড়াশোনার দায়িত্ব নিলেন নারায়ণগঞ্জ ডিসি

মর্গ্যান স্কুল ছাত্রী নিতুর পরীক্ষা ও পড়াশোনার দায়িত্ব নিলেন নারায়ণগঞ্জ ডিসি

স্টাফ রিপোর্টার, প্রেসবাংলা২৪.কম: মর্গ্যান গার্লস স্কুল এন্ড কলেজের বিশেষ বেতন দিতে না পারায় নির্বাচনী পরীক্ষায় তিন বিষয়ে ফেল করিয়ে দেয়ার অভিযোগ দেয়া ১০ম শ্রেণির ছাত্রী সেই নিতুর সার্বিক দায়িত্ব নিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মঞ্জরুল হাফিজ। মঙ্গলবার (৬ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় এ তথ্য নিশ্চিত করেন তিনি।

তিনি আরও জানান, মেয়েটিকে সামনের তিন চার মাস ভালোভাবে পড়াশোনা করতে বলা হয়েছে। তার এইচ এস সি পর্যন্ত পড়াশোনার দায়িত্ব তিনি নিয়েছেন।

প্রসঙ্গত, বিশেষ ক্লাসের ১২ মাসের বেতন ৬ হাজার টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় নারায়ণগঞ্জের মর্গ্যান গার্লস স্কুল এন্ড কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্রী নিতুকে নির্বাচনী পরীক্ষায় ৩ বিষয়ে ফেল করিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে স্কুলের সহকারি প্রধান শিক্ষক লায়লার বিরুদ্ধে।

এর আগে নির্বাচনী পরীক্ষার হল থেকে ডেকে নিয়ে ওই ছাত্রীকে ৪০ মিনিট আটকে রেখে অকথ্য ভাষায় গালাগালও করা হয়। স্কুল শিক্ষকের এহেন আচরণে ওই ছাত্রী মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন। শিক্ষার্থী ও তারা বাবা এ কথা গণমাধ্যম কর্মীদের জানিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।

আগামী বছর অনুষ্ঠেয় এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে গত বৃহস্পতিবার স্কুল ছাত্রী নিতু নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) আজিজুল হকের কাছে লিখিত আবেদন করেন। তার আবেদনের প্রেক্ষিতে ঘটনা খতিয়ে দেখতে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

লিখিত আবেদনে সূচনা দাস নিতু নামে দশম শ্রেণির মানবিক বিভাগের (রোল নং-৩) ওই ছাত্রী উল্লেখ করেন, গত ৮ নভেম্বর স্কুলে ভুগোল পরীক্ষা চলাকালীন কথিক বিশেষ ক্লাসের ফি ছয় হাজার টাকা না দেওয়ার কারণে নির্বাচনী পরীক্ষার হল থেকে তাকে ডেকে নিজের কক্ষে নিয়ে যান সহকারি প্রধান শিক্ষক লায়লা আক্তার।

এরপর তাকে বলেন, বিশেষ ক্লাসের বেতন দিতে পারো না তাহলে এই স্কুলে মরতে আসছো কেন? অন্য স্কুলে গিয়ে মরতে পার না। অনেক শিক্ষকের সামনে নিতুকে খুব বাজে ভাবে অপমান অপদস্ত করা হয়। ওই সময় নিতু বারবার তার পরীক্ষার সময় নষ্ট হচ্ছে জানিয়ে তাকে পরীক্ষার হলে যেতে দেওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু লায়লা কিছুতেই কর্ণপাত করেননি।

উল্টো নিতুকে শিক্ষিকা লায়লা বলেন, বিশেষ ক্লাসে বেতন দিতে না পারলে এই স্কুলে মরতে আসছ কেন। অন্য স্কুলে গিয়ে মরতে পার না। এতে নিতু ভুগোল পরীক্ষা খারাপ হয়। ওই ঘটনার পরদিন বিজ্ঞান পরীক্ষা থাকায় সেটিও তার খারাপ হয়েছে। ফেল করিয়ে দেওয়া হয় গনিতেও।

নিতু বলেন, আমার বাবা একটি প্রতিষ্ঠানের গার্ড ও স্বল্প আয়ের চাকুরিজীবি। আমি নিজে টিউশনি করে আমার পড়াশোনার খরচ চালাই। আমার স্কুলের কোনো মাসের বেতন বকেয়া নেই এবং পরীক্ষার ফিও দিয়েছি নিয়মিত। তবে বিশেষ ক্লাসের বেতন দিতে পারি নাই। কারণ স্কুলের বেতন ও নিজের খরচ চালানোর পর বিশেষ ক্লাসের বেতন দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

ইতিপূর্বে আমি স্কুল থেকে বেতন মওকুফ চেয়েছিলাম, কিন্তু তারা আমার বেতন মওকুফ করেনি। তারা আমাকে বলেছে যে, “স্কুলের বেতন পুরোপুরি দিলে বিশেষ ক্লাসের বেতন দেওয়া লাগবে না। সেই অনুযায়ী আমি বিশেষ ক্লাস করেছি। আমি ক্লাসের থার্ড গার্ল হয়ে পরীক্ষায় কেন ফেল করবো। বিশেষ ক্লাসের বেতনের জন্য টেস্ট পরীক্ষার হল থেকে ডেকে নিয়ে আমাকে মানসিক ভাবে অত্যাচার করা হয়েছে।

তবে নিতু দাবি করেন, সে অতীতে শুধু গনিতে ফেল করেছিল। কারণ গনিতে শিক্ষক রেখে আলাদা বেতন দেয়া মতো টাকা তাদের কাছে নেই। এবার ৩ বিষয়ে ফেল করার কথা জানার পর সে পরীক্ষার খাতা পুনর্মূল্যায়নের দাবি জানিয়ে আবেদন করলেও স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে সাফ না করে দেন।

তিনি অভিযোগ করে জানান, তিন বিষয়ের মধ্যে ভূগোল পরীক্ষা দিন আমাকে ৪০ মিনিট বিশেষ ক্লাসের বেতন দেয়ার জন্য পরীক্ষা হল থেকে ডেকে নিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। এর পরের দিনই ছিল বিজ্ঞান পরীক্ষা।

ভূগোল পরীক্ষার দিন ৪০ মিনিট দাঁড় করিয়ে রাখায় আমি সারাদিন কান্নাকাটি করেছি। পরের দিন আমার বিজ্ঞান পরীক্ষা ছিল । আমার পরীক্ষার খাতা চ্যালেঞ্জ করলেও স্কুল কতৃপক্ষ তা দেখাতে বাধ্য নয় বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন।

নিতুর পরীক্ষা দিতে চেয়ে কান্নার ধারণকৃত ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায় ১০ লক্ষ ভিউ হয়। শেয়ার হয় ২৩ হাজার। এ নিয়ে পুরো দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।

মঙ্গলবার বিকালে নিতুকে ডেকে নেয়া হয় নারায়ণগঞ্জ ডিসি অফিসে। সেখানে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মঞ্জরুল হাফিজ নিতুর সকল কথা ও তার অতীরে মেধাবী রেজাল্ট দেখে আগামী ২০২৩ সালে পরীক্ষায় অংশগ্রহনের আশ্বাস দিয়ে ভালোমতো পড়াশোর ব্যবস্থা করে দেন।

 

সূচনা দাসের বিষয়ে মর্গ্যান কর্তৃপক্ষের বক্তব্য

বিশেষ ক্লাসের ১২ মাসের বেতন ৬ হাজার টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্যবাহি মর্গ্যান গার্লস স্কুল এন্ড কলেজের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী সূচনা দাসকে নির্বাচনী পরীক্ষায় ৩ বিষয়ে ফেল করিয়ে দেওয়ার অভিযোগ তোলা হয়েছে স্কুলের সহকারি প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে। সূচনা দাসের এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। তবে এ বিষয়ে মর্গ্যান স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ গণমাধ্যমে একটি লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন। সেখানে তিনি ঘটনার আদ্যপান্ত তুলে ধরেছেন। তার বক্তব্যটি এখানে হুবহ তুলে ধরা হলো-

সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় মর্গ্যান গার্লস স্কুল এন্ড কলেজের ছাত্রী সূচনা দাসের কান্নারত ভিডিও দেখা গেছে। সূচনা দাস অত্র প্রতিষ্ঠানের দশম শ্রেণির ‘গ’ শাখার শিক্ষার্থী। এসএসসি নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সে তিন বিষয়ে অকৃতকার্য হয়। পরবর্তী সময়ে তাকে অকৃতকার্য বিষয়গুলোতে পুনরায় পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়। দ্বিতীয় বার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেও সে অকৃতকার্য বিষয়গুলোতে পাশ করতে পারেনি।

উল্লেখ্য, এ বছর মর্গ্যান গার্লস স্কুল এন্ড কলেজ থেকে মোট চারশ’ তেত্রিশ জন শিক্ষার্থী নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে দুইশ নব্বইজন কৃতকার্য হয় এবং একশ তেতাল্লিশজন শিক্ষার্থী বিভিন্ন বিষয়ে অকৃতকার্য হয়। অকৃতকার্য সব শিক্ষার্থীদের মানবিক দিক বিবেচনা করে পুনরায় ফেল করা বিষয়গুলোতে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়। যেখানে সূচনা দাসও তিন বিষয়ে ফেল করার কারণে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। দ্বিতীয়বার পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী একশ তেতাল্লিশ জনের মধ্যে ঊননব্বই জন শিক্ষার্থী কৃতকার্য হয়। চুয়ান্নজন অকৃতকার্যই থেকে যায়। যার মধ্যে সূচনা দাস একজন। তবে বিষয়টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য বিশেষ মহলের প্ররোচনায় সে কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে মিথ্যা তথ্য দিয়ে একটি ভিডিও তৈরি করে। যে ভিডিওটি জনৈক সাংবাদিকের ফেসবুক আইডি থেকে পোস্ট করে ভাইরাল করার অনুরোধ করা হয়। সাথে সাথেই ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।

সূচনা দাসের উপস্থাপিত বিভিন্ন মিথ্যা তথ্যের প্রকৃত সত্য হচ্ছে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দীর্ঘ ১০ মাসের বেতন নিয়মিত পরিশোধ না করেও বিনা বাধায় শ্রেণি কার্যক্রম-সহ সকল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে।

প্রতিষ্ঠানের নিয়মানুযায়ী নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণের পূর্বে যাবতীয় পাওনাদি পরিশোধ করতে হয় অথবা প্রতিষ্ঠান প্রধানের নিকট থেকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু সূচনা দাস তা করেনি।

জনৈক সাংবাদিক অভিযোগ করেছেন, বকেয়া পাওনা পরিশোধ না করায় তাকে ইচ্ছাকৃত ভাবে পরীক্ষায় তিন বিষয়ে ফেল দেখানো হয়েছে, যা মোটেও সত্য নয়।

প্রকৃত সত্য হচ্ছে, নির্বাচনী পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের উত্তরপত্র ‘কোড-ডিকোড’ পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করা হয়। যেখানে কোন শিক্ষকের পক্ষেই কোন শিক্ষার্থীর পরিচয় নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সেখানে ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে ফেল করানোর বিষয়টি অবাস্তব এবং ভিত্তিহীন। এছাড়া উল্লেখ থাকে যে চলতি শিক্ষাবর্ষে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সূচনা দাস ভালো ফলাফল করতে পারেনি এবং বেশ কিছু বিষয়ে সে অকৃতকার্য হয়েছিল। তাছাড়া সূচনা দাস নির্বাচনী পরীক্ষায় অকৃতকার্য বিষয়গুলোর উত্তরপত্র অভিভাবকদের দেখানোর জন্যে আবেদন করে। তারপর প্রতিষ্ঠান-কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীর আবেদনের প্রেক্ষিতে ২৮ নভেম্বর ২০২২ তারিখে তিনজন বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করেন এবং ১ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে শ্রেণি শিক্ষক প্রতিষ্ঠানের রেজিস্টারে সংরক্ষিত সূচনা দাসের অভিভাবকের ফোন নম্বরে (০১৮৭১৫৮৬১৬০) ফোন করে খাতা দেখতে প্রতিষ্ঠানে আসতে বলেন। অপরপ্রান্ত থেকে ফোনটি সূচনা দাসের মামি রিসিভ করেন। সূচনা দাসের মামী পরের দিন প্রতিষ্ঠানে আসার কথা বললেও অদ্যাবধি (৫ই ডিসেম্বর, ২০২২) কেউ আসেনি।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com