এবার যুক্তরাষ্ট্রের মানব পাচার প্রতিবেদনে সাংসদ পাপুল!
প্রতিবেদক, প্রেসবাংলা২৪ডটকম: মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বার্ষিক মানব পাচার প্রতিবেদনে কুয়েতে মানব পাচার ও অবৈধ মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক সাংসদ কাজী শহিদ ইসলামের (পাপুল) বিষয়টি এসেছে, ফলে বিষয়টির সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত এ নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের নজরে থাকবে বাংলাদেশ। ফলে এ নিয়ে এক ধরনের চাপে থাকতে হবে বাংলাদেশকে।
বাংলাদেশ সময়ে গত বৃহস্পতিবার রাতে ওয়াশিংটনে মানব পাচার বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপদেষ্টা ইভাঙ্কা ট্রাম্প।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের আটক সাংসদের নাম উল্লেখ না করেই কুয়েতের প্রসঙ্গটি এসেছে। এতে বলা হয়েছে, সাংসদসহ বাংলাদেশ সরকারের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তাই তাদের জন্য অভিযুক্ত জনশক্তি রপ্তানিকারকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া আর অভিবাসীদের জন্য বাড়তি সুরক্ষাসহ অভিবাসনবান্ধব পরিবেশ তৈরি করাটা সাংঘর্ষিক। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কুয়েতের কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে বাংলাদেশের এক সাংসদ ২০ হাজারের বেশি কর্মীকে কাজের প্রলোভন দেখিয়ে দেশটিতে নিয়ে যান। তিনি ওই সব কর্মীকে বিভিন্ন জায়গায় চুক্তির চেয়ে কম বেতনে চাকরির জন্য নিয়ে যান। কুয়েত নেওয়ার পর ওই সাংসদ কর্মীদের চুক্তির তুলনায় কম বেতন দিয়েছেন কিংবা কাউকে কাউকে কোনো বেতনই দেননি।
প্রসঙ্গত জুনের ৬ তারিখ কুয়েতের মুশরিফ এলাকার বাসা থেকে সাংসদ শহিদ ইসলামকে আটক করে কুয়েতের সিআইডি। এরপর তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে তদন্ত কর্মকর্তারা জেনেছেন সেখানকার রাজনীতিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তারা ঘুষ দিয়ে তিনি ভিসা বাণিজ্যের নামে মানব পাচার করেছেন। কুয়েতে বিভিন্ন জনকে নগদ ও চেকের মাধ্যমে ঘুষ দেওয়ার বিষয়টিও স্বীকার করছেন। এ ছাড়া কুয়েত থেকে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক দেশে তিনি টাকা পাচার করেছেন এমন তথ্যও পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। এরই মধ্যে তাঁর এক সহযোগীর পাশাপাশি কুয়েতের বেশ কয়েকজন সরকারকরী কর্মকর্তাকে আটক করা হয়েছে। শহিদ ইসলামের ১৩৮ কোটি টাকার একাধিক ব্যাংক হিসাব এরই মধ্যে জব্দ করা হয়েছে। আর তাঁকে পাঠানো হয়েছে কুয়েতের কেন্দ্রীয় কারাগারে।
কুয়েতের প্রসঙ্গ উল্লেখ করার পরপরই মানব পাচার বিষয়ক মার্কিন প্রতিবেদনে ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মালয়েশিয়ার জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের ১০ জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সিন্ডিকেটের প্রসঙ্গটি উল্লেখ করা হয়েছে। দুই দেশের সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের ঘুষ দিয়ে বাংলাদেশের কর্মী নিয়োগের বাজারটি একচেটিয়াভাবে দখলে নেয় ওই সিন্ডিকেট। মালয়েশিয়া যেতে জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা প্রত্যেকের কাছ থেকে চার লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছে। যদিও মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য সরকারের নির্ধারিত ফি ছিল ৩৭ হাজার টাকা। এর ফলে অভিবাসীরা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। দুইবার সতর্ক বার্তা পাওয়ার পরে নভেম্বরে সরকার তাদের তদন্ত রিপোর্ট হাইকোর্টে জমা দেয় এবং এর শুনানি এখনো বাকি আছে।
কী বলা হয়েছে এবারের প্রতিবেদনে:
দেশের ভেতরে আর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানব পাচারে বাংলাদেশিদের সম্পৃক্ততা আর এই অপরাধে জড়িতদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো বিচার হচ্ছিল না। তাই গত তিন বছর ধরেই মার্কিন মানব পাচার প্রতিবেদনে দ্বিতীয় ধাপের নজরদারি দেশের তালিকায় আটকে ছিল বাংলাদেশ। পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় বাংলাদেশে এবার তালিকায় দ্বিতীয় স্তরে উঠে এসেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর তাদের বৃহস্পতিবারের প্রতিবেদনে বলেছে, মানব পাচার রোধের ন্যূনতম শর্ত পুরোপুরি পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ। তবে তা অর্জনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চেষ্টা চালিয়েছে। তাই বাংলাদেশকে দ্বিতীয় ধাপে উন্নীত করা হলো।
প্রসঙ্গত মার্কিন ওই প্রতিবেদনে চারটি ধাপ রয়েছে। এগুলো হলে প্রথম, দ্বিতীয়, দ্বিতীয় ধাপের নজরদারি ও তৃতীয় স্তর।
মার্কিন প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের সরকারি হিসাব অনুযায়ী ২০১৯ সালে মানবপাচারের অভিযোগে ৬৪৪টি মামলা হয়েছে। নিষ্পত্তি হওয়া চারটি মামলায় ১১ জনের যাবজ্জীবন ও তিনজনের অন্যান্য মেয়াদের শাস্তি হয়েছে। ২০১৮ সালে মোট মামলা হয়েছে ৫৪৭টি। ৩৪টি মামলা নিষ্পত্তির পর সাতজনের যাবজ্জীবন এবং একজনের অন্য মেয়াদে শাস্তি হয়েছে।
গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের মানব পাচারের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় ছিল এ অভিযোগের বিচার না হওয়া। ২০১৯ সালের নভেম্বরে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এলিস ওয়েলস ঢাকা সফরের সময় বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। পরে পররাষ্ট্র, আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি গুরুত্ব বুঝতে পেরে ব্যবস্থা নেওয়ার ওপর জোর দেন। এরপরই সরকার সাতটি বিভাগীয় শহরে সাতটি মানবপাচার ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করাসহ প্রয়োজনীয় বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।
মার্কিন প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের পাচারের প্রসঙ্গটি এসেছে। এতে বলা হয়েছে, এ নিয়ে ‘শত শত বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদনের’ তদন্ত হওয়া উচিত। বাংলাদেশ থেকে নৌকা বোঝাই করে মালয়েশিয়ায় রোহিঙ্গা পাচার করা হচ্ছে। মালয়েশিয়ায় পৌঁছানোর চেষ্টা করা অনেক শরণার্থীকে জিম্মি করা হচ্ছে এবং তাদের আত্মীয়দের মুক্তপণ দিতে বাধ্য করা হচ্ছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এ ধরনের প্রতিবেদনে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের সমালোচনা হয়ে থাকে। ফলে সরকারের প্রতিক্রিয়া সব সময় তির্যক হয়ে থাকে। এবার বাংলাদেশের নাম তালিকায় এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এটিকে বড় অর্জন হিসেবে অভিহিত করেছেন। আজ সকালে প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে এক ভিডিও বার্তায় আব্দুল মোমেন বলেন, টিয়ার টু ওয়াচ লিস্টে চলে যাওয়ায় আমাদের অনেক ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। আমরা মার্কিন সহায়তা, বিশ্ব ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সহজ শর্তের ঋণ থেকে বঞ্চিত হতাম। সুখের খবর আমাদের অবস্থার উন্নতি হয়েছে।
অভিবাসী বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম সিদ্দিক সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, আমাদের অভিবাসীদের কর্মীদের নিয়ে যে মানব পাচারকারীরা ফাঁদে ফেলছে তা প্রতিহত করার জন্য সরকারের প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া দরকার। লিবিয়ার বিয়োগান্ত ঘটনার পর দেখলাম আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বেশ কিছু লোককে আটক করেছে। এরপর কি হচ্ছে আমরা কিন্তু জানি না। অর্থাৎ কোথাও কিছু ঘটলে আমরা তৎপর হয়ে উঠি। এরপর সবকিছু থেমে যায়। কুয়েতে বাংলাদেশের একজন সাংসদ যে আটক হলেন তাঁর সম্পর্কে এখন পর্যন্ত সরকারের কাছ থেকে কিছু শুনতে পাইনি।