করোনা রোগী সনাক্ত

বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যু ১হাজার ছাড়ালো শনাক্ত ৭৫হাজার প্রায়

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) দেওয়া তথ্যমতে, দেশে করোনা শনাক্ত ১০ হাজার ছাড়িয়েছে ৫৮ দিনে, এদিন শনাক্ত ছিল ১০ হাজার ১৪৩ জন। ২০ হাজার ছাড়িয়েছে ৬৯ দিনে, এদিন শনাক্ত ছিল ২০ হাজার ৬৫ জন। ৩০ হাজার ছাড়িয়েছে ৭৬ দিনে, এদিন আক্রান্ত ছিল ৩০ হাজার ২০৫ জন। ৪০ হাজার ছাড়িয়েছে ৮২ দিনে, এদিন আক্রান্ত ছিল ৪০ হাজার ৩২১ জন। ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে ৮৬তম দিনে, এদিন আক্রান্ত ছিল ৫২ হাজার ৪৪৫ জন এবং ৬০ হাজার ছাড়িয়েছে ৮৯ দিনে। আর ৯৩তম দিনে শনাক্ত বা আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৪ হাজার ৮৬৫ জন।

মৃত্যুর হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশে করোনা শনাক্তের ১৪তম সপ্তাহে মারা গেছেন ২৩৮ জন। এই সপ্তাহের প্রথম দিনে (১ জুন) ২২ জন, দ্বিতীয় দিনে ৩৭ জন, তৃতীয় দিনে ৩৭ জন, চতুর্থ দিনে ৩৫ জন, পঞ্চম দিনে ৩০ জন, ষষ্ঠ দিনে ৩৫ জন এবং সপ্তম দিনে ৪২ জন, আর ৮ জুন ৪২ জন মারা গেছেন। দেশে এখন করোনা শনাক্তের ১৫তম সপ্তাহ চললেও বিগত সপ্তাহের সাত দিনের গড় মৃত্যু হচ্ছে ৩৪ জন, যা অন্য যেকোনও সময়ের চেয়ে বেশি। এ পর্যন্ত মোট মৃত্যু এক হাজার ১২ জন। এরমধ্যে মার্চে ৫ জন, এপ্রিলে ১৬৩ জন, মে’তে ৪৮২ জন এবং জুনে এখন পর্যন্ত ৩৬২ জন মৃত্যুবরণ করেছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের দেশে ‘স্পেশাল রাইজ’ আছে। সেগুলোর সঙ্গে অন্য দেশের পরিস্থিতি মিলবে না। ঈদের পর দেশে করোনার যে উত্থানের কথা বলা হয়েছিল, এখন সেটাই হচ্ছে। করোনার পরিসংখ্যান মাঝে দেখা যাবে একটি সরলরেখায় যাচ্ছে। যদি পদক্ষেপ নেওয়া হয় তাহলে এটা কমতে শুরু করতে পারে। এখন গড়ে আড়াই হাজার আক্রান্ত পাওয়া যাচ্ছে, পদক্ষেপ না নিতে পারলে এটি ছাড়িয়ে যাবে সামনে। দেশের হটস্পটগুলোতে কঠোরভাবে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে সামনে আরেকটি উত্থান দেখা যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।

করোনা মোকাবিলায় জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আজকে ১০ জুন, গত মাসের ২৫ তারিখ ছিল ঈদ। তার আগে প্রচুর মানুষ বাড়ি চলে গেলো। বাড়িতে ঈদ করে আবারও ফিরে এসেছে। ঈদের আজ ১৪ দিন পার হয়ে গেছে। এটার প্রভাব দেখা যাচ্ছে। গতকাল (মঙ্গলবার, ৯ জুন) কিন্তু সেই প্রভাব দেখা গেছে। আমরা আগেই বলেছিলাম, ৯-১০ জুনের দিকে আমরা একটি উত্থান দেখবো। এটাই হচ্ছে সেই উত্থান। এটাকে পিক বলা যাবে না। এখন কিন্তু আমরা আগের চেয়ে সংখ্যার দিক দিয়ে আরেকটু বেড়ে যাবো। এটা আমাদের আশঙ্কা।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রস্তুতির ঘাটতি আছে। আমরা এখনও কিছু করতে পারিনি। আমাদের ন্যাজাল ক্যানুলা প্রয়োজন, সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্রয়োজন, এগুলো এখনও তেমন করা হয়নি। এগুলো দরকার রোগীর চিকিৎসার প্রয়োজনে। আর রোগী যাতে না বাড়ে তার জন্য আমাদের মেলামেশা কমাতে হবে। মাস্ক পরতে হবে, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে। এগুলো না মেনে আমরা বাড়ি গেলাম আবারও ফেরত আসলাম। কীভাবে যাওয়া-আসা হলো, এটা সবাই দেখেছে। আমরা যদি রোগী বাড়ানোর ক্ষেত্রে এতগুলো কাজ করে থাকি, রোগী তো বাড়বেই। জনসাধারণকে আমরা বুঝাতে পারছি না। ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য আমরা মানুষকে বুঝাতে পারিনি— এটা আমাদের ব্যর্থতা। যার জন্য এখন রোগী বেড়ে যাচ্ছে। আজকে আরেকটু বাড়বে বলে মনে হচ্ছে।’

অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘‘অন্যান্য দেশে কতগুলো ঘটনা ঘটে না। যেমন- গার্মেন্টস খুলে দিলো, শ্রমিকরা আসলো। আবারও বললো ‘বন্ধ’, চলে যেতে। তারপর ঈদ আসলো, এ সময় অনেকগুলো মানুষ বাড়ি গেলো আবার আসলো। এই ঘটনাগুলো বাইরের দেশে ঘটে না। সেজন্য আমাদের দেশে ‘স্পেশাল রাইজ’ আছে। সেগুলোর সঙ্গে অন্য দেশের পরিস্থিতি মিলবে না। ঈদ তো মানুষ করবেই, কিন্তু সেটা একটু ভিন্নভাবে করা উচিত। কিছু মানুষ ব্যক্তিগত সুরক্ষার বিষয়টি বুঝে, আবার অনেকেই এসব কেয়ার করে না। আমাদের তাই আরেকটা উত্থান হবে— সামনে আরেকটা ঈদ আছে। করোনার পরিসংখ্যান মাঝে দেখা যাবে একটি সরলরেখায় যাচ্ছে, যদি আমরা পদক্ষেপ নিতে পারি, তাহলে এটা কমতে শুরু করতে পারে। এখন গড়ে আড়াই হাজার আক্রান্ত পাওয়া যাচ্ছে, পদক্ষেপ না নিতে পারলে এটি ছাড়িয়ে যাবে সামনে।’’

প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা প্রথম থেকেই করোনা প্রতিরোধ এবং আক্রান্তদের চিকিৎসার বিষয়ে কোনও পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা তৈরি করিনি। সেটা না করার কারণে আমাদের যেসব রিসোর্স আছে, সেগুলোর পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার আমরা করতে পারিনি। ফলে সব জায়গায় একটি হযবরল অবস্থা তৈরি হলো। এজন্য বলবো এখন যেটুকু সময় আছে, আমাদের সব রিসোর্সকে একত্রিত করে, একীভূত পরিকল্পনার কথা সরকারের ভাবা উচিত। এখন যদি আমরা শুধু লকডাউন করে রাখি এবং শুধু জোনে ভাগ করে রাখি— সেটা কিন্তু সমস্যার সমাধান নয়। এখানে মূল বিষয় হচ্ছে, আমাদের বৃত্তের ভেতরে বৃত্ত তৈরি করতে হবে। ঢাকার ভেতরে যেগুলো হটস্পট আছে, এগুলো ঘিরে ফেলে আমাদের নিবিড় পরীক্ষা অভিযান চালাতে হবে। এর মধ্য দিয়ে কে রোগী, কে ভাইরাসবাহী এটা আমরা শনাক্ত করতে পারবো। এভাবে যদি আমরা ক্রমশ এগোই তাহলে রেড জোনের হটস্পটগুলো ক্রমেই ইয়োলো এবং গ্রিন জোনে আমরা আনতে পারবো। শুধু ঘোষণা দিয়ে কিন্তু আমরা সামান্যই প্রতিরোধ করতে পারবো, পুরোটাকে আমরা থামাতে পারবো না।’

লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘আমার ধারণা, আমরা যে প্রথম পর্যায়ে আছি, সেটা থেকে পিকের দিকে যাচ্ছি। এক্ষেত্রে পরীক্ষা আরও ব্যাপক আকারে হলে ভালো বলা যেতো। এখন যা পরীক্ষা হচ্ছে তার শতকরা ২১-২২ ভাগ পজিটিভ শনাক্ত হচ্ছে। যদি এক লাখ পরীক্ষা করা যেতো, তাহলে হতো ২১-২২ হাজার প্রতিদিন। সব হিসাব করে বলা যায়, আমরা প্রথম পর্যায়ের পিকের কাছাকাছি। বর্তমান যে অবস্থা এটি আরও ১০-১৫ দিন থাকবে। এটি তারপর কমে এসে জুলাইয়ের প্রথম দিকে দ্বিতীয় ধাক্কা দেবে আমাদের।’

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বেনজির আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রতিদিন যদি এরকম ৩ হাজার আক্রান্ত পাওয়া যায়, এরমধ্যে এক হাজার মানুষেরও যদি হাসপাতালে ভর্তির দরকার পড়ে, কিংবা ৫০০ মানুষের দরকার পড়লেও আমাদের হাসপাতালগুলো অনেক বেশি চাপে পড়বে। সামনে মোকাবিলা করা খুব কঠিন হবে। আমাদের যেগুলো হটস্পট আছে, যেখানে অনেক বেশি কেস আছে, সেখানে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। আক্রান্ত চিহ্নিত করে আইসোলেশনে রাখতে হবে। যারা আক্রান্তের সংস্পর্শে এসেছিল, তাদেরও চিহ্নিত করতে হবে এবং কঠোর আইসোলেশনে রাখতে হবে। এভাবে আমরা হটস্পটগুলোতে আক্রান্তের সংখ্যা কমাতে পারবো। এটা যদি করতে পারি ব্যাপক আকারে এবং একজন থেকে আরেকজন আক্রান্তের আনুপাতিক হার কমিয়ে দুই কিংবা একে নিয়ে আসতে পারি, তাহলে আমরা হয়তো সামাল দিতে পারবো। এজন্য আমাদের সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে— যার জন্য লোকবলের প্রয়োজন আছে। আমরা যদি তা করতে পারি তাহলে সংক্রমণ কমিয়ে আনতে পারবো।’

তিনি আরও বলেন, ‘ল্যাটিন আমেরিকা কিংবা ইউরোপে আক্রান্তের পরিসংখ্যান যেভাবে ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে, আমাদেরটা সেভাবে হয়নি। বিগত দুই মাসে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে, কিন্তু এই ধারাবাহিকতা অতটা দ্রুত না। দুই মাস যাওয়ার পরও আমাদের কমছে না— এটাও একটি পার্থক্য অন্য দেশের সঙ্গে। অন্য দেশ কমাতে পারলেও আমরা পারিনি। দ্রুত উত্থান না হওয়ার কারণ হতে পারে আমরা সেভাবে পরীক্ষা করতে পারছি না। আমাদের টেস্টের সংখ্যা কম। আমরা আরেকটা ভুল করছি যে সন্দেহজনক কেসগুলো আমরা রিপোর্ট করছি না। সাসপেক্টেড কেসের সঙ্গে পজিটিভ কেসের তুলনা করলে সমস্যাটা আরও ভালোভাবে বুঝতে পারতাম। আমরা বলার পর এখন হটস্পটগুলোকে রেড জোন করা হচ্ছে। এরকম যদি এক হাজার জায়গায় আমরা করতে পারি এবং সেখানে সংক্রমণ কমাতে পারি, ভাইরাস বহনকারী ব্যক্তিদের চলাচল বন্ধ করতে পারি, তাহলে হয়তো আমাদের সংক্রমণের গতি কমে আসবে। নতুবা আমরা আরেকটি উত্থান আগামী এক-দুই মাসের মধ্যে দেখতে পারি।’

 

 

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com