গুজব ছড়ানোর অপরাধে গ্রেফতার ৫৫

প্রতিবেদক, প্রেসবাংলা২৪ডটকম: করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের মধ্যে আমাদের দেশে অন্যান্য অপরাধ তুলনামূলক কমলেও ঠিক উল্টোপথে ছুটছে গুজব রটনাকারীরা। তাদের সংখ্যা কম হলেও গুজব রটনা সমাজকে আতঙ্কিত করছে সর্বদা।
করোনা পরিস্থিতিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের উপস্থিতি বেশ লক্ষ্য করা যায়। আর তাদের গ্রেফতারের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও ব্যাপক তৎপর। সাইবার টিম এই দুষ্ট চক্রের বিরুদ্ধে নজরদারি বৃদ্ধি করে সারা দেশে ৫০-এর অধিক অপরাধীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। যারা ভুয়া আইডি খুলে দেশ-বিদেশ থেকে করোনার বিষয়ে বা দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে যাচ্ছে তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে।
সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগ করোনাকালীন নানা গুজব রটানোর দায়ে ৪০ জনকে গ্রেফতার করেছে। অন্যদিকে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র্যাবের সাইবার ইউনিটি আরও ১৫ জনকে গ্রেফতার করে আইনের কাছে সোপর্দ করেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যারা সমাজ ও রাষ্ট্রকে নিজ বা গোষ্ঠীর স্বার্থসিদ্ধির জন্য প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে অস্থিতিশীল করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব নিয়ে অপরাধ দমন করা হবে।
পুলিশ জানিয়েছে, করোনা নিয়ে নানা রকমের গুজব ছড়ানো হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। একটি চক্র করোনাকে পুঁজি করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটছে। নানা ধরনের মিথ্যাচার ও গুজব রটিয়ে সাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। চক্রের সদস্য সোশ্যাল মিডিয়া, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে গুজব ছড়াচ্ছে। বেশ কয়েক দিন ধরে পুলিশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ৫০টির অধিক আইডির সন্ধান পায় যারা এমন অপরাধে জড়িত। এছাড়া আরও শতাধিক আইডি থেকে একই ধরনের কাজ হচ্ছে বলে প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করতে পেরেছে। এর বাইরে প্রায় দুই শতাধিক আইডিকে সন্দেহের তালিকায় রেখেছে। এরই মধ্যে বিটিআরসির মাধ্যমে রাজধানীসহ সারা দেশে ৫০টি ফেসবুক আইডি বন্ধ করে দেওয়ার কার্যক্রম চলছে। এসব আইডির মালিকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
সামাজিক কাঠামো পরিবর্তনের মাধ্যমে গুজব রোধ সম্ভব
গুজব হলো দীর্ঘদিনের একটা ম্যাকানিজম বা প্রসেস। যার মধ্য দিয়ে কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের স্বার্থ থাকতে পারে কিংবা আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে অতি উৎসাহিত হয়ে অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কার থেকে প্রপাগান্ডা বা গুজবের আবির্ভাব। আমাদের ট্রাডিশনাল সমাজ ব্যবস্থায় অন্ধ বিশ্বাস, কুসংস্কার ও অজ্ঞতার কারণে গুজব জড়াচ্ছে মানুষ। উন্নত বিশ্বেও এক সময় এই ধরনের প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে সমাজ ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে তোলা হতো। কালের বিবর্তনে এবং দেশের মানুষের মাঝে আধুনিকায়নের ছোঁয়ায় সেগুলো আজ তাদের কাছে অতীত। সেসব দেশে আজ পজিটিভ রিজন হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করছেন তারা। তারই ফলশ্রুতিতে ঐতিহাসিকভাবে রেঁনেসা বা শিল্প বিপ্লব ও আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা হয়েছে। সেখানে আইনের কঠোর অনুশাসন ব্যবস্থা থাকার কারণে সেগুলো এখন অতীত। কিন্তু আমাদের দেশে সমাজ ব্যবস্থা আধুনিকায়ন না হওয়াতে আমরা কুসংস্কার, অন্ধ বিশ্বাসকে পুঁজি করে গুজবকে ভালোভাবে কাজে লাগাচ্ছি। এই ধরনের গুজব যে আজকের সৃষ্টি তা নয়। ১৯০৮ সালে বসনিয়ার এক শিশুর মা-বাবার কবরের ছবি দেওয়াকে ভিন্নভাবে মিডিয়ায় ছাপিয়ে গুজব ছড়িয়ে সামাজিক ভারসাম্যতা বা কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করেছিল। গুজব ছড়ানোর একটা মনস্তাত্ত্বিক একটা সোশ্যাল বা ইকোনমি একটা ভ্যালু রয়েছে। হতে পারে সেটা রাজনৈতিক কারণেও।
আমাদের দেশে কিছু শ্রেণির মানুষ আছে যারা এখানে অন্ধ বিশ্বাস ধারণ করে চাইলেও তাদের ফিরিয়ে আনা যাবে না আমাদের সমাজ ব্যবস্থার কারণে। দেশে কিছু মানুষ ধর্মীয় অন্ধ গোঁড়ামির সঙ্গে জড়িত আবার কিছু লোক জেনে এবং না জেনে গুজবে কান দিয়েই সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইক কমেন্টস করে যাচ্ছে যা সমাজের বিরূপ মনোভাব তৈরি হচ্ছে। মিথ্যে গুজব ছড়িয়ে সমাজে অস্থিরতা যারা তৈরি করছে সরকারের সরকার উচিত শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ বা দমন করা করা। সোশ্যাল ট্রাকচার পরিবর্তনের মাধ্যমে বা সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে পারলে এটা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব।
গুজব রটনাকারীরা সমাজ ও রাষ্ট্রের শত্রু
গুজব রটিয়ে মানুষকে আতংকিত করা কোনো মতেই কাম্য নয়। গুজব রটনাকারীরা সমাজ ও রাষ্ট্রের শত্রু। রাষ্ট্রযন্ত্রকে অকেজো করার জন্য স্বার্থান্বেষী মহল এই কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আবার অনেকেই অন্ধ বিশ্বাসে এর সঙ্গে জড়িত হচ্ছে। তাই তাদের প্রতিহত করার জন্য র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) করোনাভাইরাস আতঙ্কের সুযোগে গুজব ঠেকাতে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছে র্যাবের সাইবার মনিটরিং সেল। দেশজুড়ে র্যাবের ১৫টি ব্যাটালিয়ন প্রত্যেকের জায়গা থেকে নিয়মিত বিষয়গুলো মনিটরিং করছে।
ভার্চুয়াল জগতে গুজব প্রতিরোধে জড়িতদের শনাক্ত করে দ্রুতই আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। গত ১৫ মার্চ থেকে আজ পর্যন্ত করোনা সম্পর্কিত গুজব ছড়ানোর ঘটনায় ১৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। র্যাবের নিয়মিত দায়িত্বের পাশাপাশি করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকার নির্দেশিত নানা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দেশজুড়ে মাঠপর্যায়ে কাজ করছে র্যাব। তার মধ্যে সাইবার মনিটরিং অন্যতম। প্রত্যেকটি ব্যাটালিয়নের নিজস্ব সাইবার মনিটরিং সেল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো নজরদারি করছে। বিশ্বজুড়েই সাইবার যুদ্ধ চলছে এবং প্রচলিত নিয়মেই তা প্রতিহত করা হচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় সমাজের মানুষকে সচেতন করে গড়ে তোলা। সমাজের মানুষ সচেতন হলেই গুজব নামে শব্দটি বিলীন হয়ে যাবে একদিন।