নারী দিবস নিয়ে ভাবনা ও কিছু কথা
ড. জেবউননেছা, প্রেসবাংলা২৪ডটকম: আব্বু আম্মু ছেলেবেলা থেকে আমাকে ‘মানুষ’ হিসেবে বড় করে তুলেছেন,কখনো কোনদিন বুঝতে দেননি, আমি কন্যা। তিনটা ভাই এর একটা বোন আমি, কোনদিন বুঝিনিও আমার বোন নেই। ভাইদের সাথে ব্যাডমিন্টন, ক্যারম, দাবা খেলেছি, একসাথে শিশুপার্কে ঘুরে বেরিয়েছি। ঈদে ভাইয়েরা নিতো একসেট করে জামা আর আমি নিতাম তিনটা। দাদুর পরিবারে, নানুর পরিবারে আদরের আহলাদে বেড়ে উঠেছি।
নারায়ণগঞ্জ থেকে রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত শিশুশিল্পী হিসেবে সাংস্কৃতিক অনুষ্টানগুলো তে অংশগ্রহণ ছিল আমার। কবিতা আবৃত্তিতে জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতায় জেলা পর্যায়ে বিভাগ পর্যায়ে ছেলেদের সাথে অংশগ্রহণ করে অসংখ্য পুরস্কার ছিনিয়ে নিয়েছি।অংশগ্রহণ করেছি নতুন কুঁড়িতে। ১৬ বছর আগে আব্বু পাত্রস্থ করেছেন আমাকে। তাতে কি। ১৬ সেকেন্ড ও বুঝতে দেননি তারা, আমি বাবার বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছি।আমার প্রতিটি কথা প্রতিটি আবদার রাগ অভিমান আগের মতই আছে।
যে বাড়িতে কেটেছে আমার সোনালী শৈশব,সে দাদু বাড়ি আব্বু আমাদের চার ভাইবোন কে সমান অংশ দিয়েছেন।আমার অংশে নির্মান করেছি মনের মতো একটি ফ্ল্যাট, যদিও একা পড়ে থাকে সে ফ্ল্যাট,তাও আত্মতুষ্টি হারাই নি তো আমি। আব্বু আমার তিন ভাইয়ের জন্মদিনের তারিখ বয়সের কারণে এলোমেলো করে ফেলেন। কিন্ত আমার জন্মদিনর তারিখটি তার নখদর্পনে।
ছেলেবেলা ঢাকার বিখ্যাত ধুপখোলা মাঠের মেলা থেকে আমার জন্য কাঠের ঘোড়া কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রতিদিন বিকেলে ছাদে সেই ঘোড়ায় চড়িয়ে দিতেন।মাথায় লাগিয়ে দিতেন মেজো চাচার ব্যবহৃত পরচুলা। (মেজো চাচা চলচ্চিত্রে অভিনয় করতেন)।
সেই শৈশবের কাঠের ঘোড়ার টকটক শব্দ আমাকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দেয়। আমার বাবার পরিবারে একজন কন্যা নয় মানুষ হিসেবে বড় হয়েছি বলে আমার মধ্যে নারী দিবসের এই দিনটিকে বিশেষ দিন মনে হয়না ( এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত)। নারী দিবস মানে আমি পিছনে পড়ে থাকা একটি গোষ্টি। নাহ আমি পিছনে পড়ে থাকা গোষ্টির সদস্য নই। রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে শুরু করে রান্নার লাকড়ি যোগাড় করার দায়িত্ব পর্যন্ত কোনটায় নেই নারীরা?? আমাদের নারীরা এখন কাজ করছে,এগিয়ে যাচ্ছে। আমার কাছে নারী দিবস প্রতিদিন।
আমার মায়ের জীবন থেকে দেখেছি,তিনি ঘুম থেকে উঠে নামাজ সেরে কোরান পড়তেন, এরপর আব্বুর অফিসের খাবার রেডি করতেন, এরপর আমাদের স্কুলে পাঠাতেন। এরপর রান্না করতে। এরপর সংসারে কখন কি লাগবে, আমাদের বইখাতা, কাপড় চোপড়, স্কুলে ভর্তি সব করতেন আম্মু। আমাদের চার ভাইবোনকে বর্ণমালার শিক্ষা দিয়েছেন, দিয়েছেন পবিত্র কোরআন শিক্ষা। নারায়ণগঞ্জ জেলা পর্যায়ে সকল সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় আম্মু নিয়ে যেতেন আমাকে। পাশাপাশি আমার দাদীকে খেদমত করেছেন। ফুপ্পিদের আপ্যায়ন করেছেন। নিজে সেলাই মেশিনে কাপড় সেলাই করতেন। আম্মুর হাতে বোনা সোয়েটার, টুপি আমার কাছে সংরক্ষিত আছে।
এরপর ছুটির দিনে আব্বুর সাথে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্টানে আম্মু যেতেন সাথে আমরা চারভাইবোন থাকতাম।
এই এত ব্যস্ততায় আশি দশকে ‘অলংকার’কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করলেন। যে গ্রন্থের ‘আমাদের জেবউন’ কবিতায় লিখলেন,
‘আমাদের আদরে সোহাগে জেবউন ধন্যা,
জেবউনের জন্য প্রাণে বয় স্নেহের বন্যা’।
এমন কবিতাতো আম্মু আমার তিনভাইকে নিয়ে লিখেননি। আমাকে নিয়ে লিখেছেন। এরপর প্রকাশ করলেন উপন্যাস। এখন তিনি ছয়টি প্রকাশিত গ্রন্থের রচয়িতা। পাশাপাশি মানুষ করলেন আমার তিনটি ভাইকে। যার একজন ইঞ্জিনিয়ার, একজন কৃষিবিদ একজন জনস্বাস্থ্যবিদ। আম্মুর বুদ্ধিমত্তায় দাদুর দোতলা ভবন থেকে নতুন করে পাঁচতলা ভবন নির্মিত হলো। আর ও বাড়ি কেনা হলো। আর ও কত কি। আব্বু সরকারি চাকরি করতেন, তাই সব আম্মুই করেছেন।
আমার পরিশ্রমী মনোভাব, জেদী মানসিকতা আম্মুর কাছ থেকে নেয়া। আর আমি যে সংসারে এসেছি, আমার জীবন সঙ্গী সংসারের সকল দায়িত্ব আমার উপর দিয়ে নির্ভার থাকেন। আর আমিও আনন্দ নিয়েই সংসারের সুতা কেনা থেকে শুরু করে সব কিছুই কিনি। এতগুলো কথা বলার একটিই কারণ, আমি নারী হিসেবে বাবার বাড়ি থেকেও যেমন বৈষম্যের শিকার হইনি, শশুড়বাড়িতে ও নই। এমনকি কর্মক্ষেত্রে ও নই। আমার কর্মক্ষেত্রে আমার বিভাগে আমার পুরুষ সহকর্মীবৃন্দ কখনই আমি নারী বলে আমার কোন মতামতকে উপেক্ষা করেননি। বরং আমার উপর তারা আস্থা রাখেন, আমার উপর ভরসা করেন।
তাহলে আমার জীবনে ‘নারী দিবস’ প্রতিদিন।
আমার মায়ের কাছ থেকে শিখেছি,নারী নও মানুষ হিসেবে সামনের দিকে এগিয়ে যাও। বিভিন্ন অনুষ্টানে নারী বিষয়ক বক্তব্যে আমি একটাই কথা বলি,কেউ কাউকে স্থান দেয়না,স্থান করে নিতে হয়।সমান অধিকার সমান অধিকার বলে শ্লোগান নয়।সমানাধিকার অর্জনের লক্ষ্যে রুদ্রমূর্তি হয়ে কাজে লেগে যেতে হবে।তাতেই সার্থকতা নারীর। ক্যারিয়ার, ক্যারিয়ার করে মানসিক অশান্তি না বাড়িয়ে,সংসারকে সমানভাবে শ্রদ্ধা করে,সংসারের দায়িত্ব পালন করে সামনে এগুতে পারলেই নারীর সার্থকতা। যে সমাজ আমি ভাংতে পারবনা,যে সমাজের রীতিনীতি আমার কাছে শ্রদ্ধার সম্মানের।সে সমাজে বাস করেই ‘অনন্যা’ হয়ে উঠার জন্য কাজ করে যেতে হবে।
আমি প্রগতিশীল কিন্ত নারীবাদী নই। আমি যে সমাজে বাস করি, সে সমাজের রীতিনীতিকে সম্মান শ্রদ্ধা করেই দাঁড়াতে হবে আমি এই নীতিতে বিশ্বাস করি।
সুতরাং নারী দিবস একদিন নয়,নারী দিবস প্রতিদিন।নারী শ্রদ্ধার নারী ভালবাসার,নারী শক্তির আধার। নারী তুমি এগিয়ে যাও,দৃপ্ত প্রত্যয়ে আলোর নিশান হাতে। পৃথিবীর সকল নারীর প্রতি শ্রদ্ধা।।।সেই সাথে পৃথিবীর সকল মা’কে সালাম। আর সৃষ্টিকর্তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ, তিনি আমাকে নারীরূপে পৃথিবীতে প্রেরন করেছেন, আমি নারী না হলে ‘মা’ হতাম কি করে। আমি নারী পুরুষের সমান অধিকারে বিশ্বাস করি,কিন্ত কোনভাবেই পুরুষকে প্রতিযোগী হিসেবে না ভেবে। পুরুষ আমাদের সহযোগী, প্রতিযোগি নন। নারী পুরুষ সবাই মিলে এই ধরণির সমস্ত গাছপালা সবুজ হউক এই প্রত্যাশা।রংধনুর সাত রং সমানভাবে বিকিরত হউক নারী পুরুষের জীবনে।
ড. জেবউননেছা
সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
লোকপ্রশাসন বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।