আলোকিত সমাজ গঠনে শিক্ষকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ: ড. জেবউননেছা

প্রতিবেদক, প্রেসবাংলা২৪ডটকম: শিক্ষা আলোকিত সমাজ বিনির্মাণের হাতিয়ার আর শিক্ষক হলো তার সুনিপুণ কারিগর। কথায় আছে, হাজার দিন গভীর অধ্যয়নের চেয়ে একদিন শিক্ষকের সাহচর্য উত্তম-জাপানি এই প্রবাদ বিশ্লেষণ করলে শিক্ষকদের মর্যাদা ও গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। এ কারণেই গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, যারা শিশুদের শিক্ষাদানে ব্রতী তারা অভিভাবকদের থেকেও অধিক সম্মানীয়। পিতা-মাতা আমাদের জীবনদান করেন ঠিকই। শিক্ষকরা সেই জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেন। তেমনই এক আলোকিত-গুণী-আপন মহিমায় উদ্ভাসিত শিক্ষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের’র লোক প্রশাসন বিভাগের প্রথম নারী চেয়ারপার্সন, সহযোগী অধ্যাপক ড. জেবউননেছা। তিনি শুধু একজন শিক্ষকই নন, প্রাবন্ধিক, সমাজকর্মী এবং মুক্তিযুদ্ধ গবেষক। তাঁর কলম আজো প্রগাঢ় দাম্ভিকতায় চলমান।
‘প্রাচ্যের ড্যান্ডি’ নামে খ্যাত নারায়ণগঞ্জ জেলার শীতলক্ষ্যার তীর ঘেঁষে ‘সাহিত্য পল্লী’ নলুয়া’য় ১৯৮০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ড. জেবউননেছা। তাঁর দাদা বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত এবং আন্তজার্তিক পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘জাগো হুয়া সাভেরা’র অভিনেতা। তাঁর দাদী দেশের বিখ্যাত কলামিষ্ট ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ওয়াহিদুল হকে’র ফুফু। তাঁর পিতা নারায়ণগঞ্জের ষাট দশকের বিশিষ্ট কবি ও নাট্যকার, চত্বর সাহিত্য স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত, নারায়ণগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক-২০১৮ পুরস্কারপ্রাপ্ত ও ১৩টি গ্রন্থের প্রণেতা আলহাজ্ব মুঃ জালাল উদ্দিন নলুয়া। তাঁর মা ৫টি গ্রন্থের লেখক এবং ‘এম এ কুদ্দুস শ্রেষ্ঠ মা, ২০১৩’ পদকপ্রাপ্ত আলহাজ্ব লুৎফা জালাল।
ড. জেবউননেছা নারায়ণগঞ্জ আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ থেকে ১৯৯৪ সালে এসএসসি ও ১৯৯৬ সালে এইচএসসি পাশ করেন। ২০০৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগ থেকে স্নাতক, স্নাতকোত্তর প্রথম বিভাগ অর্জন করেন এবং একই বিভাগ থেকে এম ফিল ডিগ্রি অর্জন করেন। ভারতের বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরী কমিশন এবং গভর্ন্যান্স বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর উচ্চতর গবেষণা দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের একমাত্র গবেষণা। আন্তর্জাতিক সংগঠন ইএনডিপিতে ২০০৪ সালে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন, পরবর্তীতে বিয়াম মডেল স্কুল এন্ড কলেজ, গণবিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন এবং পরবর্তীতে ২০১০ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন তিনি। বর্তমানে তিনি সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। শিক্ষকতার পাশাপশি তিনি ১০টি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। আরো চারটি গ্রন্থ প্রকাশের পথে। এছাড়া জাতীয় এবং আন্তজার্তিক জার্নালে তাঁর বেশকিছু গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থ ‘আলোকিত নারীদের স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ’ নামক গ্রন্থটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সেকায়েপ প্রকল্পের ‘পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কর্মসূচী’র অন্তর্ভূক্ত। তিনি রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডি সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বিষয়ে গবেষণা করেন এবং অনুসন্ধান করে বের করে নিয়ে আসেন উক্ত বিদ্যালয়টি ১৯৭১ এ পাক হানাদারদের ৩১ ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের ক্যাম্প ছিল। উক্ত বিষয়টি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ‘মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্মৃতি সংরক্ষণ প্রকল্পের অন্তর্ভূক্ত’ হয়ে বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে একটি ‘মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ’ নামে শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছে। তিনি বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের মাসদাইরের ‘রংপুর হাউসে’ অবস্থিত শহীদ তৌফিক সাত্তার চুন্না এবং শহীদ জালাল উদ্দিন হায়দার রানার কবরকে শহীদের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করার জন্য কাজ করছেন। উল্লেখ্য, এই দুজনকে ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ এক কবরে বিনা কাফনে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটি চাপা দেয় পাক হানাদার বাহিনী।
শিক্ষাজীবনের কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল ছাড়াও গবেষণার জন্য তিনি বিভিন্ন সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। সেগুলো হলো-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রোকেয়া হল স্বর্ণপদক-২০০২ (ছাত্রী জীবনের কৃতিত্বস্বরূপ), এনটিভি ষ্টার শিপ জুস টিফিনের ফাঁকে সম্মাননা-২০০৫, চত্বর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ থেকে সাহিত্য গবেষণায় ‘চত্বর সাহিত্য পদক, ২০১১’; এমএ কুদ্দুস শ্রেষ্ঠ শিক্ষয়িত্রী পদক-২০১২, নারায়ণগঞ্জ জেলা পর্যায়; মৃত্তিকা পদক-২০১৪ (সংস্কৃতিসেবী); বিনোদনধারা পারফরম্যান্স এ্যাওয়ার্ড, বিশেষ সম্মাননা-২০১৪ (তরুণ মুক্তিযুদ্ধ গবেষক); আমরা কুঁড়ি পদক-২০১৪ (তরুণ মুক্তিযুদ্ধ গবেষক); বঙ্গবীর ওসমানী স্মৃতি পুরস্কার-২০১৩ (তরুণ মুক্তিযুদ্ধ গবেষক); বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক পরিষদ (বাসাপ এ্যাওয়ার্ড)-২০১৩ (তরুণ মুক্তিযুদ্ধ গবেষক); নক্ষত্র সাহিত্য পদক-২০১৩ (তরুণ মুক্তিযুদ্ধ গবেষক); অক্ষর সম্মাননা স্মারক-২০১৬ (কবিতায়); জাতীয় সাহিত্য পরিষদ সম্মাননা-২০১৭ (সাহিত্যে) ইত্যাদি। তিনি প্রায় ২০ এর অধিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন। সম্প্রতি তিনি ‘শিক্ষকের দৃষ্টিতে শিক্ষাঙ্গন’ কলামের জন্য সাক্ষাৎকারে অংশগ্রহণ করেন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার প্রতিনিধি ভবতোষ কুমার সরকারের সাথে। সেই সাক্ষাৎকারের টুকরো অংশ তুলে ধরা হলো।
প্রেসবাংলা: দেশের শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গন নিয়ে কিছু ভাবছেন?
ড. জেবউননেছাঃ শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গন নিয়ে ভাববার অনেক কিছু আছে। শিক্ষাঙ্গন বলতে আমি শুধু বিশ্ববিদ্যালয়কেই ভাবছি না; প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয়সহ পুরো শিক্ষাঙ্গনের যে সেক্টরগুলো আছে, সেগুলো নিয়েই ভাবছি। আমরা শিক্ষাক্ষেত্রে যে পথে আছি, তা কি আদতেই সঠিক পথ কিনা, আমাদের দিক নির্দেশনা ঠিক আছে কি না-সবকিছু মিলিয়ে আমাদের স্বাধীনতার যে ৫০ বছর পূর্তি উৎসব পালন করতে যাচ্ছি, তাতে শিক্ষাঙ্গনে কতটুকু সাফল্য অর্জন হলো তা নিয়েও ভাবছি। ভাবছি কিভাবে শিক্ষাঙ্গনকে আরো গতিশীল করে তোলা যায়।
প্রেসবাংলা: আপনি যখন ছাত্রী ছিলেন তখনকার শিক্ষার পরিবেশের সঙ্গে বর্তমান সময়ের শিক্ষার পরিবেশের কি কি পার্থক্য দেখছেন?
ড. জেবউননেছাঃ পার্থক্য তো অনেক, ভীষণ রকমের ব্যবধান আছে। ১৯৯৪ সনে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। ৯৬’ তে এইচএসসি। ৬ বছর বয়সে সরাসরি তৃতীয় শ্রেণিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। শিক্ষাঙ্গন বা শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ বলতে বাড়িকেও অন্তর্ভূক্ত করতে পারি। যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি। চাচাতো ভাই-বোন মিলে আমরা দশ ভাই-বোন ছিলাম। সন্ধ্যা হলে সবাই যার যার বাসায় একই সময়ে পড়তে বসতাম। পাশের বাড়িতে আমার চাচাতো ভাই-বোনেরা পড়ছে, এদিকে আমি ও আমার আপন ভাইয়েরা পড়ছি। এই যে একটা প্রতিযোগিতা ছিল, তা এখন আর তেমন লক্ষ্য করা যায় না। পারিবারিক বন্ধনটা এখন আগের মতো মজবুত নেই। পূর্বে বাবা-মায়ের কড়া শাসন ছিল। আর এখনকার বাচ্চাদের শাসনই করা যায় না। এছাড়াও বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দিচ্ছে পড়াশোনার ক্ষেত্রে। বলছে-আমি পড়তে পারি যদি আমায় গেমস কিনে দাও, পড়তে পারি যদি পিৎজা কিনে দাও। এরকম নানা ধরনের শর্ত দিয়ে তারা পড়াশোনা করছে। আমাদের সময় কিন্তু এরকম ছিল না। আমরা নিজেদের মতো করে লেখাপড়া করেছি, বাবা-মা যেটা দিয়েছে সেটা নিয়েই অনেক খুশি থেকেছি।
প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশ সম্পর্কে বলতে পারি, আমি যেখানে পড়েছি তা ছিল নারায়ণগঞ্জ আদর্শ বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ। আমি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সহশিক্ষায় পড়েছি। স্কুলে আমি এবং আমার সহপাঠীরা ক্লাশ, পড়ালেখা এবং খেলাধুলা নিয়েই সময় কাটাতাম। এখনকার মতো মোবাইল, ফেইসবুক, ইন্টারনেট ছিল না। আর ছিল না বলেই তখন সবার প্রতি আন্তরিকতা বেশি ছিল। যেমন- আমরা দুপুরে টিফিন পিরিয়ডে সবাই মিলে খেলাধুলা করতাম। একদিন টিফিনে আমি খেলতে না চাওয়ায় আমার এক সহপাঠী আমাকে ধাক্কা মেরে মাথা ফাটিয়ে দিলো। এখনকার ছেলে-মেয়েরা এমন না। তাদের মনোভাব হলো-খেলতে চাও না, খেলবা না, শেষ।
তাছাড়া আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের কাঁধে এত বই তুলে দিয়েছি যে, তারা বইয়ের ভারে নুইয়ে পড়ছে। উন্নত দেশগুলোতে প্রাথমিক পর্যায়ে পড়তেই হয় না, আর আমরা বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছি শিশুদের ঘাড়ে। সবকিছু মিলিয়ে আমার মনে হয় আমাদের সময় শিক্ষাটা খুবই আনন্দময় ব্যাপার ছিল, চাপিয়ে দেয়ার মতো কিছু ছিল না। আমরা পড়াশোনা শেষ করে খেলাধুলা করার মতো যথেষ্ট সময় পেতাম। এখনকার ছেলেমেয়েদের এত চাপ যে তারা খেলাধুলা করার সময় পায় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা যদি বলি, আমাদের সেই সময়কার সহপাঠীরাও এখনকার মতো ছিল না। এখন সবার ভেতরে একটা আলাদা এবং কৃত্রিম জগত তৈরি হয়ে গেছে। ভালো লাগছেনা; মোবাইলে গেইমস খেলছে। ভালো লাগছে না; সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সময় কাটাচ্ছে। এখনকার ছেলেমেয়েরা অতি মাত্রায় এ্যাডভান্স, যা অনেক সময় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যেমনÑ সময়ের আগে যদি গাছের ফল পেঁকে যায়, তবে সেই ফলে আসল তৃপ্তিটা থাকে না।
প্রেসবাংলাঃ শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার ক্ষতি না করে শিক্ষা-সহায়ক ও সৃজনশীল কি কি কর্মকান্ডে নিয়োজিত হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
ড. জেবউননেছাঃ শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার ক্ষতি না করে শিক্ষা-সহায়ক বা সৃজনশীল বিভিন্ন ধরনের কর্মকান্ডে নিয়োজিত হতে পারে। আমি আমার ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতার কথাই বলতে পারি। আমার বাবা-মা দু’জনই কবি। আমার জন্ম হয়েছে কবিতার মধ্যে, সাহিত্যের মধ্যে। যেহেতু আমি সাংস্কৃতিক পরিবারের মেয়ে, তাই নারায়ণগঞ্জের যত সাংস্কৃতিক সংগঠন আছে প্রায় সবকয়টা সংগঠনে শিশুশিল্পী হিসেবে অংশগ্রহণ ছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়েও আমি প্রায় ১৮টি সংগঠনের সাথে জড়িত হই। যে কারণে আমার লেখাপড়া আর সংগঠনের বাইরে কিছু করার সময় ছিল না। এছাড়া আমি বিশ^বিদ্যালয়ে হাওয়াইন গীটারও শিখেছি। তাই আমি বলতে পারি, শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন রকম সৃজনশীল কর্মকান্ডে জড়িত হতে পারে। যেমনÑ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৯০ টি’র মতো সংগঠন আছে। তারা ইচ্ছে করলে বিতর্ক, বিএনসিসি, রোভার স্কাউট, গার্লস গাইড এবং ক্যারিয়ার ক্লাব করতে পারে। এছাড়া, বিভিন্ন সামাজিক সচেতনতামূলক কাজ করতে পারে, যেমনÑ বৃক্ষ রোপন কর্মসূচি, মাদকের বিরুদ্ধে কর্মসূচি, বই লেখা-বই পড়া কর্মসূচি, সাংস্কৃতিক সপ্তাহ পালন, রক্তদান কর্মসূচি ইত্যাদি। এক্ষেত্রে তাদের ইচ্ছাটাই আসল। ইচ্ছা থাকলে তারা শিক্ষা সহায়ক আরও বিভিন্ন ধরনের কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে শুধু শিক্ষার্থীদের নয়; শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও ভূমিকা থাকতে হবে।
প্রেসবাংলা: কর্মজীবনে আপনি অনেক প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করেছেন, কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে আপনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন?
ড. জেবউননেছাঃ আসলে এক এক কর্মক্ষেত্রের অনুভূতি এক এক রকম। আমার কর্মজীবন শুরু করেছি ইউএনডিপি’র প্রকল্প দিয়ে। ওটা আমার কর্মজীবনের সূতিকাগার। আন্তজার্তিক সংগঠনের মধ্য দিয়ে আমার কর্মজীবন শুরু হয়। আমি উক্ত সংগঠন থেকে যা যা শিখেছি, তা পরবর্তীতে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে কাজে লেগেছে। কারণ, ওখানে দেশ-বিদেশের বড় বড় বিশেষজ্ঞরা যেতেন। তাঁদের কাছে থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। যেমনÑইউএনডিপিতে একজন অস্ট্রেলিয়ান ভদ্রমহিলা ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক ড. শার্লি র্যান্ডেল। তাঁর কাছ থেকে আমি প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মনীতি শিখেছি। ভালো লেগেছে যখন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরী কমিশনে-এর সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) হিসেবে দায়িত্বপালন করেছি। আমি ছিলাম ওখানকার প্রশাসন বিভাগের প্রথম নারী সহকারী পরিচালক (প্রশাসন)। এখন যেখানে আছি অর্থাৎ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আমার সবচেয়ে ভালো লাগা এবং ভালোবাসার জায়গা।
প্রেসবাংলা: আপনি জীবনে এতদূর এসেছেন কিভাবে? আপনার সাফল্যের সংগ্রামী ইতিহাস বর্তমান প্রজন্মের উদ্দেশ্যে বলবেন কী?
ড. জেবউননেছাঃ আমার জীবনের গল্প তো অনেক বড়। প্রত্যেকটি গল্পের মাঝেই তিক্ততা থাকে, কষ্ট থাকে, সংগ্রাম থাকে, ব্যর্থতা থাকে। আর এই সংগ্রাম শুরু হয় জন্ম থেকেই। আমার এই জায়গাটিতে আসতেও অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। যদিও আমি পুরোপুরি সফলতা অর্জন করতে পারিনি, তবে চেষ্টা করছি আমার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য। আমার জীবনের প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার ক্ষেত্রেই আমাকে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। এসএসসি পরীক্ষার এক সপ্তাহ পূর্বে আমার গুটি বসন্ত হলো, কিন্তু আমি সেখানে হার মানিনি। কারণ, আমি আমার পড়াগুলো আগে থেকে প্রস্তুত করে রেখেছিলাম যার ফলে আমি লেটারসহ স্টার মার্ক পাই। আবার এইচএসসি পরীক্ষার এক সপ্তাহ পূর্বে জন্ডিসে আক্রান্ত হলাম। পরীক্ষার কিছুদিন পূর্বে ঘোষণা দেয়া হলো, সব বোর্ডের জন্য অভিন্ন প্রশ্ন হবে। যেহেতু আমি পড়–য়া ছিলাম, তাই আগে থেকেই সব পড়া পড়ে রাখতাম; যে কারণে আমি মানবিক বিভাগ থেকে নারায়ণগঞ্জ জেলার মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলাম। সে বছর ঢাকা বিভাগে ১ লক্ষ ৭৬ হাজার পরীক্ষার্থীর মধ্যে ২ হাজার ৫০জন প্রথম বিভাগ পায়। আমি কখনো কোনো গৃহ শিক্ষকের কাছে পড়িনি বা কোনো কোচিং করিনি। ২০০৪ সালের ১৩ মে আমি এমএসএস পাশ করি। ঐ মাসেরই ১৪ তারিখে আমার বিয়ে হয় এবং ১৯ তারিখে আমার চাকরি হয়। এক সপ্তাহের মধ্যেই তিন-তিনটি ঘটনা এবং নতুন জীবনের অভিজ্ঞতা। ইউএনডিপি প্রজেক্টে যোগদান করলাম এবং পাশাপাশি অন্যকিছু করার জন্যও চেষ্টা করতে থাকলাম। এরপর যোগদান করলাম বিয়াম ফাউন্ডেশনে বিয়াম মডেল স্কুল এন্ড কলেজে। এরপর চাকরি হয় সাভারে গণবিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক হিসেবে। মতিঝিল থেকে প্রতিদিন সাভারে যেতাম। সন্তান জন্মগ্রহণের ২৪ দিন পূর্বে ছুটি নিয়েছি। যেহেতু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, তাই ছুটি নেয়ার সুযোগ কম ছিল। বাচ্চার ৩ মাস ৭ দিনের সময় আমার মায়ের কাছে নারায়ণগঞ্জে সন্তানকে রেখে ঢাকায় চলে আসি। কারণ, আমার স্বামী ছাড়া বাচ্চাকে দেখাশোনা করার মতো কেউ ছিল না। তখন প্রতি বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জ মায়ের বাড়ী চলে যেতাম এবং শুক্রবার বিকেলে ফিরে আসতাম। এরপর ২ বছর ৮ মাস বয়সের সময় আমি ঢাকায় নিয়ে আসি। এর মধ্যে আমি জাহাঙ্গীরনগরে যোগদান করি। তবে মাঝখানে আরো একবছর বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরী কমিশনে চাকরি করি। এটা হচ্ছে আমার ব্যক্তি জীবনের সংগ্রাম। আমার পেশাগত সংগ্রামও বেশ বড়। ভালো একটা চাকরির জন্য অনেক জায়গায় চেষ্টা করেছি। কখনো কারো সহযোগিতা বা রেফারেন্সের জন্য তদবির করিনি। আমার যোগ্যতার উপর বিশ্বাসী ছিলা। তবে আমি বেশ কিছু জায়গায় বঞ্চনার শিকার হয়েছি, যেখানে মেধা-যোগ্যতাকে তারা সমানভাবে দেখেনি। তারপরও আমি কখনো থমকে দাঁড়াইনি বা হাল ছেড়ে দেইনি। আমার বিশ্বাস ছিল-যেহেতু আমি সৎভাবে পড়ালেখা করেছি, আমাকে থমকে দাঁড়ালে চলবে না। আমি দেখতে চেয়েছিলাম, এই পথ আমাকে কোথায় নিয়ে যায়! আমি একরকম যুদ্ধ করে করে একটার পর একটা চাকরি ছেড়ে অবশেষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আলোর দেখা পেয়েছি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে আমি এজন্যে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। তাঁরা আমার মেধা এবং যোগ্যতাকে সম্মান করেছেন, আমার অভিজ্ঞতাকে সম্মান করেছেন, আমার প্রতি অবিচার করেননি। আমি স্নাতকোত্তর উত্তীর্ন হয়েছি ২০০৪ সালে এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছি ২০১০ সালে। কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছাতে ৬ বছরের উপরে সময় লেগেছে, অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমার বার্তা হলো, সব সময় সৎ থাকতে হবে। লেখাপড়া শেষ করে কারো উপরে ভরসা করার মনোভাব পরিহার করতে হবে। নিজে নিজে চেষ্টা করেছি। আমার মনে শক্তি ছিল। নতুন প্রজন্মের প্রতি আমার পরামর্শ বা উপদেশ যেটাই বলি না কেন, তারা যেন নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকে। শিক্ষার্থীদের বলছি-সততার পথ বন্ধুর, যেখানে একটি বন্ধুও থাকবে না। তবুও সৎ পথ পরিহার করা যাবে না। আর তাছাড়া লেখাপড়া শেষ করে চাকরিই কেন করতে হবে? আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এই দেশে এখন স্ট্রবেরির চাষ হচ্ছে, উন্নত প্রজাতির হাইব্রিড মাছের চাষ হচ্ছে, এগ্রো-ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক এগিয়ে গেছে। মৎস্য চাষে ভালো করছে, আইটি সেক্টরেও ভালো করছে। তাহলে কেন পাশ করে আমাকে চাকরির পেছনে দৌঁড়াতে হবে? আমাদের যতটুকু পুঁজি আছে, তা দিয়েই অনেক কিছু করতে পারি। কর্মসংস্থান ব্যাংক আছে, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন আছে সাহায্য করার জন্য। আমাদের দেশটাকে ভালোবাসতে হবে। দেশের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে হলে দেশকে ভালোবাসা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
প্রেসবাংলা: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রধান হবার পর আপনি কোন বিষয়টির প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন?
ড. জেবউননেছাঃ বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর একাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রণয়ন করেছি। এছাড়া আমার বিভাগের শিক্ষার্থীবৃন্দের সময়মত পরীক্ষা গ্রহণের বিষয়ে যত্নশীল থাকার চেষ্টা করছি। বিভাগকে সেশনজ্যাম মুক্ত করার জন্য আমার সহকর্মীরবৃন্দদের সাথে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছি। এ বিষয়ে আমার সহকর্মীবৃন্দ যথেষ্ট আন্তরিক।
প্রেসবাংলা: যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে এ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, তার বাস্তবায়ন কতটুকু সফল হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
ড. জেবউননেছাঃ ২০১৮ এর ফেব্রুয়ারির ২৩ তারিখে বিভাগের এক যুগ পূর্ণ হয়েছে। এক্ষেত্রে এক যুগ তেমন কিছুই না। তবে পরিণতির দিকে তাকালে দেখা যায়। শিক্ষার্থীরা চেষ্টা করছে ভালো ভালো জায়গায় নিজেদেরকে নিয়োজিত করার।
প্রেসবাংলা: বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর আপনি কী কী উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন তা বলবেন কি?
ড. জেবউননেছাঃ লোক প্রশাসন বিভাগের ছাত্রী হিসেবে প্রশাসনকে যেভাবে চালাতে হয়, সেভাবে আমি আমার সহকর্মীদের সহযোগিতায় প্রত্যেকটি জায়গার কাজ নিখুঁতভাবে করার চেষ্টা করছি। বিভাগে নিয়মিত সেমিনার, শিক্ষাসফর, ইফতার পার্টি, নবীনবরণ, বিদায় সংবর্ধনা করছি। আধুনিক শ্রেণিকক্ষ বলতে যা বোঝায়, আমার বিভাগের শ্রেণিকক্ষগুলো তথ্য প্রযুক্তিসম্পন্ন করেছি। বিভাগীয় আভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজকর্ম করছি। বিভাগকে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার আওতাধীন করেছি। এছাড়া বিভাগের কম্পিউটার ল্যাব সেমিনার গ্রন্থাগার সংস্কার করেছি।এ বিষয়ে শতভাগ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন আমার সম্মানিত সহকর্মীবৃন্দ এবং বিভাগীয় অফিসের কর্মচারীবৃন্দ।
প্রেসবাংলা: আপনার বিভাগের গবেষণা কার্যক্রম সম্পর্কে বলবেন কী?
ড. জেবউননেছাঃ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন গবেষণা আছে, সমাজ বিজ্ঞানে গবেষণা আছে, এমফিল এবং পিএইচডি প্রোগ্রাম রয়েছে। আমাদের বিভাগ ছোট, তবুও এখানে একজন অধ্যাপকসহ চারজন শিক্ষক পিএইচডি ডিগ্রিপ্রাপ্ত। দেশের বাইরে তিনজন পিএইচডি করছেন। দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ আছেন, যারা আমাদের বিভাগ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং করছেন।
প্রেস বাংলা: আপনার বিভাগ থেকে পাস করার পর শিক্ষার্থীরা চাকরির বাজারে কেমন করছে?
ড. জেবউননেছাঃ আমাদের ছেলেমেয়েরা প্রশাসন, পুলিশ, ব্যাংক, এনজিও, বিসিএস, সংবাদমাধমে এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আছে। যারা আমার সরাসরি ছাত্র ছিল, তার মধ্যে নিজ বিভাগে পাঁচজন এবং বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছে। প্রায় সব সেক্টরেই তারা আছে। তাছাড়া আমাদের শিক্ষার্থীবৃন্দ আন্তর্জাতিকভাবে গবেষণায়ও ভালো করছে। তাদের অর্জনে আমি সন্তুষ্ট।
প্রেসবাংলা: নিজ বিভাগ সর্বোপরি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে আপনার স্বপ্নের কথা জানতে চাচ্ছি।
ড. জেবউননেছাঃ আমি আমার বিভাগকে শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক নয় সারা বাংলাদেশে একটি অতুলনীয় বিভাগ হিসেবে দেখতে চাই। আর সেটা যে আমার সময়েই হতে হবে তা নয়, দশ বছর বা বিশ বছর পরেও হতে পারে। আমি আমার বিভাগকে সেরা বিভাগ হিসেবে দেখতে চাই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আমার ভালোলাগার একটি জায়গা, আমার স্বপ্ন পূরণের জায়গা, আমার অহংকারের জায়গা। এই বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন। খ্যাতিতে, সম্মানে, উচ্চতায়, সৌন্দর্য্য,ে নান্দনিকতায় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের পরই এটার অবস্থান। আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে দেখতে চাই। পৃথিবীর আর কোথাও এত সুন্দর বিশ্ববিদ্যালয় আছে বলে আমার জানা নাই, যেখানে বিদেশি পাখিরাও নিজেদেরকে নিরাপদ বলে মনে করে।
প্রেসবাংলা: বলা হচ্ছে, উন্নত বিশ্বের শিক্ষার মানের সাথে আমরা তাল মেলাতে পারছি না- এ ব্যাপারে আপনার মতামত জানতে চাচ্ছি।
ড. জেবউননেছাঃ উন্নত বিশ্বের শিক্ষার মানের সাথে আমরা তাল মিলাবো কিভাবে? আমাদের তো গোঁড়াতেই কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। উন্নত বিশ্বের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনও বেশি, সম্মানও বেশি। আমাদের দেশে দু’টোই কম। শিক্ষার মান তখন উন্নত হবে যখন শিক্ষা, শিক্ষক নিয়োগ এবং পাঠদান প্রক্রিয়া পরিপূর্ণতা পাবে। উন্নত বিশ্বে মেধা ও যোগ্যতাকে প্রাধান্য দেয়া হয়। কাজেই, আমাদের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। কারণ এই সংস্কৃতি যতদিন থাকবে, ততদিন আমরা উন্নত বিশ্বের শিক্ষার মানের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারব না। কেউ যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়, সে ৩৬ বছর বা তার চেয়ে বেশি সময়ের জন্য হয়। রাজনৈতিক দল কিন্তু ৩৬ বছর থাকেনা। সুতরাং নিয়োগে যিনি থাকেন তার চিন্তা করা উচিত, এই শিক্ষকটি ৩৬ বছর শিক্ষার্থীদের পড়াবেন। তাঁর উপর নির্ভর করবে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ। তাই যে শিক্ষকটি যোগ্যতায় আসবে, সে পরবর্তীতে অবশ্যই যোগ্য ও মেধাবী শিক্ষার্থী তৈরি করবে। তাই উন্নত বিশ্বের শিক্ষার মানের সাথে তাল মেলাতে হলে আমাদের সেরকম পরিবেশও নিশ্চিত করতে হবে। সেক্ষেত্রে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে, নইলে আমরা মেধাবী শিক্ষক পাব না।
প্রেসবাংলা : ছাত্র ও শিক্ষকদের মাঝে কেমন সম্পর্ক হওয়া উচিৎ বলে আপনি মনে করেন?
ড. জেবউননেছাঃ একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের অভিভাবক হিসেবে কাজ করে। তাই শিক্ষকের কাজ শুধু ক্লাসে পড়িয়েই চলে আসা নয়। শিক্ষকের কাজ যেমন পাঠদান করা, তেমনি পেছনের সারিতে যে সমস্ত শিক্ষার্থী বসে থাকে তাদেরকে ডেকে এনে কাউন্সেলিং করা, ক্লাসের বাইরে তাদেরকে সময় দেয়া, যারা একেবারেই বা নিয়মিত ক্লাশে আসছে না, তাদের খোঁজ-খবর নেয়া। আমি ব্যক্তিগতভাবে সবসময় তা করি। কে প্রথম কে দ্বিতীয় আমি তা খুঁজি না; সবচেয়ে খারাপ যে করলো, আমি তাকে খুঁজে বের করি। তার সাথে কথা বলি, প্রয়োজনবোধে আমি তার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলি। ছাত্র-ছাত্রীরা কাঁদা মাটির মতো। তাদেরকে তৈরি করে নিতে হবে। তারা বাবা-মাকে ছেড়ে যখন আমাদের কাছে আসে, তখন আমরাই অভিভাবক। আমরা যদি ক্লাশে গিয়ে শুধু পড়িয়েই চলে আসি, তাহলে হবেনা। তাদেরকে নিজের সন্তানের মতো ভাবতে হবে। তবে এক্ষেত্রে শুধু শিক্ষকদেরই দায়বদ্ধতা থাকবে তা নয়; শিক্ষার্থীদেরও দায়বদ্ধতা আছে। শিক্ষকদেরকে সম্মান করতে হবে, শ্রদ্ধা করতে হবে। আর এটা তাদেরকে পরিবার থেকে শিখতে হবে।বিনয় ন¤্রতার বিকল্প নেই।
প্রেসবাংলা: ছাত্র-যুবকদের উদ্দেশ্যে আপনার মূল্যবান পরামর্শ জানতে চাচ্ছি।
ড. জেবউননেছাঃ যেকোনো দেশের ছাত্র-যুবক সে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। বাংলাদেশ এখন যুবকদের দেশ। এদেশের ছাত্ররা ৪৮ এনেছে, ৫২ এনেছে, ৬৯ এনেছে, ৭১ এনেছে। ছাত্ররা বরাবরই সচেতন ছিলো। আমরা যতই বলি, ছাত্ররা নষ্ট হয়ে গেছে, আসলে কিন্তু তা নয়। ছাত্র-যুবকদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে গতি, এটা তাদের নিজেদের মধ্যে আনতে হবে। শুধু নিজেকে নিয়ে নয়; সমাজ এবং দেশকে নিয়ে, সর্বোপরি দেশের মানুষকে নিয়ে ভাবতে হবে। কোনো কাজ ফেলে রাখা যাবে না, কাজের সময় অলসতা করা যাবে না। বরং কালকের কাজ আজকে করতে হবে এবং আজকের কাজ এখনই করতে হবে। কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করা যাবে না। মিথ্যাবাদীকে, দুর্নীতিবাজকে, ঘুষখোরকে ঘৃণা করতে হবে। দেশকে ভালোবাসতে হবে। সঙ্গদোষে লোহা ভাসানো যাবে না বা স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়া যাবে না। এছাড়া মাদক, ধুমপান, সাইবার ক্রাইম থেকে বিরত থাকতে হবে। আমরা ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারি, তবে তা যেন আমাদের জীবনের গঠনমূলক কাজে লাগে। গান শুনবে, সংস্কৃতি চর্চা করবে, খেলাধুলা করবে, সাঁতার কাটবে, এলাকার ভেতরে যুব সংগঠনসহ আরো অনেক কিছু করতে পারে। সর্বোপরি, শত শহীদের এই দেশ বাংলাদেশকে মন থেকে ভালোবাসতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শতভাগ শ্রদ্ধা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে ভালোবাসতে হবে দেশের পতাকাকে। এই সবুজের মাঝে লাল পতাকার সূর্যই হলো আমাদের তরুণরা। তাদের হাতেই দেশ, প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ।
প্রেসবাংলাঃ জ্ঞানভিত্তিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ এবং আলোকিত জাতি গঠনে অগ্রযাত্রায় আপনার পরামর্শ জানাবেন কি?
ড. জেবউননেছাঃ আপনারা একেক সময় একেক বিশ্ববিদ্যালয়কে টার্গেট করতে পারেন। এরপর বিভিন্ন বিভাগের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে পারেন। তাতে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে একটা উদ্দীপনা কাজ করবে। এছাড়া বিভিন্ন সময় শিক্ষাবিদদেরও জীবনের গল্প তুলে ধরতে পারেন। একটি সুন্দর আলোকিত সমাজ গঠনে শিক্ষকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।