ইট থেকে শুরু করে বাড়ির থালা বাসনও নিয়ে গেছে দস্যু রতনরা!

সোনারগাঁ প্রতিনিধি, প্রেসবাংলা২৪ডটকম: প্রথমে প্রতিপক্ষকে হত্যা মামলা দিয়ে বাড়ি ছাড়া করানো হয়েছে। মামলায় পুলিশের গ্রেফতারের ভয়ে বাড়িঘর ছাড়া পুরুষরা। আর এই সুযোগে বাড়ির ইট থেকে শুরু করে দোতলা বাড়ির ভেতরে থাকা মূল্যবান জিনিষপত্র এমনকি খাবারের থালা-বাসনও নিয়ে গেছে প্রতিপক্ষরা।
ঘটনাটি ঘটেছে সোনারগাঁয়ের সনমান্দি ইউনিয়নের টেমদিতে। পাশের গ্রামের দস্যু আবুল কাশেম রতনের লোকজন প্রতিপক্ষ ইসহাক আহমেদের ওই বাড়িতে হামলা চালিয়ে বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাট করে। কিন্তু পুলিশকে জানানোর পরেও তারা কোন ব্যবস্থা নেয়নি। ইসহাক আহমেদের অভিযোগ, পুলিশ রতনদের পক্ষ নিয়েছে। এতবড় একটি ঘটনা। প্রায় কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হলেও পুলিশ একদম নির্বিকার।
ওই ইউনিয়নের একপক্ষের দাবী মাহবুব নামের একজনকে পেটানোর কারনে কয়েক মাস পরে সে মারা গেছে। অন্য পক্ষের দাবী পেটানোর ঘটনায় মাহবুব আহত হয়। কিন্তু পরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সে মারা যায়। আর এটিকে হত্যা হিসেবে চালিয়ে দিয়ে তাদের আসামী করা হয়েছে। এই কথিত হত্যাকান্ডে অভিযুক্ত করে সন্মানদী ইউনিয়নের টেমদি গ্রামের গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ইসহাক ও তার আত্মীয়দের বাড়িতে দফায় দফায় হামলা, লুটপাটের ঘটনা ঘটছে। প্রতিপক্ষের ভয়ে ইসহাক পক্ষের লোকজন এখন গ্রাম ছাড়া।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, টেমদি গ্রামের ইসহাক আহমেদের দো’তলা বাড়িটি ইটও খুলে নিয়ে গেছে প্রতিপক্ষরা। যার দেয়ালের বিভিন্ন স্থানে ভাঙ্গা। ভাঙ্গা দেয়াল দিয়ে দেখা যায় বাড়িরও বিভিন্ন জায়গা ভাঙ্গা। দরজা, জানালা, চৌকাঠ খুলে নেয়া হয়েছে। ভেতরে ঢুকে দেখা গেলো খুলে নেয়া হয়েছে বাড়ির টাইলসও। বাড়িতে কোনো আসবাবপত্র নেই।
গত সোমবার এ বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই দেখা হলো কান্নারত মিলি বেগমের সাথে। তিনি গার্মেন্ট ব্যাবসায়ী ইসহাক মিয়ার বোন। মিলি বেগম জানালেন, গত ৩ অক্টোবর রাতে পাশের লেদামদী গ্রামের রতন মিয়ার ৫০-৬০ জন লোক রাম দা, তলোয়ার, হাতুড়ি, শাবল নিয়ে প্রথমে তাদের বাড়িতে ও এ গ্রামের অন্যান্য বাড়িতে যায়। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঘোষণা দেয়, তারা এখন ইসহাকের বাড়ি ভেঙ্গে নিয়ে যাবে। কেউ বের হলে তার ‘ইজ্জত লুট’ করা হবে। আগেও বেশ কয়েকবার রতন মিয়ার লোকজন এ গ্রামে হানা দিয়েছে। তাই কয়েকদিন ধরে এ গ্রাম এমনিতেই পুরুষ শূন্য। রতন মিয়া সন্মানদী ইউনিয়ন বিএনপি’র সাবেক সভাপতি। তিনি ইলেকট্রনিক পণ্যের ব্যবসায়ী।
ইসহাকের প্রতিবেশী ও আত্মীয় রোজিনা বেগম জানান, ২৩ আগষ্ট প্রথমবার ইসহাকের বাড়িতে ও আশেপাশের বেশ কয়েকটি বাড়িতে হামলা চালায় লেদামদী গ্রামের লোকজন। এসময় তাদের বাড়িও একই কারণে লেদামদী গ্রামের লোকজন লুট করেছে।
ইসহাকের বাসার কাজের লোক ও প্রতিবেশী রুবিনা আক্তার জানান, গত ২৫ সেপ্টেম্বর প্রথমে ইসহাকের বাসায় কাজ করার কারনে তাকে মারধর করা হয়। তার গরু বাছুর নিয়ে যায় রতনের লোকজন। গত ৩রা অক্টোবর আবারো রতনের লোকজনকে আসতে দেখে তিনি ভয়ে বাসায় তালা দিয়ে পাশের ক্ষেতে গিয়ে পালিয়ে ছিলেন। লেদামদী গ্রামের লোকজন তার বাড়ির তালা ভেঙ্গে ভাত খাওয়ার থালাটি পর্যন্ত নিয়ে গেছে।
টেমদি থেকে লেদামদী গ্রামের দূরত্ব প্রায় অর্ধ কিলোমিটার। লেদামদী গ্রাম থেকে পাশের সাধুরবাগ পর্যন্ত বারো ফুট প্রশস্ত প্রায় পৌনে এক কিলোমিটার দীর্ঘ একটি ব্যাক্তিগত রাস্তা তৈরী করেন। একটি রাস্তা তৈরীর রাস্তাটি তৈরী করা নিয়ে লেদামদী গ্রামের প্রভাবশালী রতন মিয়ার সাথে পাশের টেমদী গ্রামের ব্যবসায়ী ইসাহাক মিয়ার বিরোধ দেখা দেয়। রতন মিয়া ইসহাক মিয়ার জমির উপর দিয়ে রাস্তা নিতে চাইলে ইসহাক মিয়া এতে বাধা দেন। ইসহাক মিয়ার ভাই হারুন বলেন, রতন মিয়ার বাড়িতে যাওয়ার আগে থেকেই রাস্তা রয়েছে। তিনি সম্প্রতি গাড়ি কিনেছেন। এ গাড়ি তার বাসা পর্যন্ত নেয়ার জন্য তিনি এ রাস্তা তৈরী করেন। রাস্তায় করতে গিয়ে আমাদের কোনো জমি পুরো নিয়ে নিয়েছে, কোনো জমি এমনভাবে গর্ত করেছে যে বাকি জমিতে পানি জমে থাকে। এভাবে সে আমাদের প্রায় পাঁচ বিঘা জমি এই ব্যাক্তিগত রাস্তার জন্য নিয়ে নিয়েছে।
রতনের আত্মীয় লেদামদী গ্রামের বাসিন্দা হাজী মোহাম্মদ সেলিম বলেন, এই বিরোধের জের ধরেই রতনের মামাতো ভাই মাহবুবকে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর মাছের প্রজেক্টে একা পেয়ে কুপিয়ে ও পিটিয়ে মারাতœক আহত করে ইসহাকের লোকজন। ঢাকা মেডিকেলে সে ৩১ ডিসেম্বর থেকে ৯ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত ৪১ দিন চিকিৎসাধীন ছিলো। তার পা ভেঙ্গে গিয়েছিলো। গত ২৩ আগষ্ট মারা যায় মাহবুব হোসেন। তার বাবার নাম শাহজাদা মিয়া।
তার মা সুফিয়া বেগম ও স্ত্রী শারমিন আক্তার দাবী করেন, ডিসেম্বর মাসে পেটানোর জের ধরেই মাহবুবের মৃত্যু ঘটে।
তবে ইসহাকের ভাই হারুন জানান, রতনরা বিএনপি সমর্থক। আমরা আওয়ামীলীগ। এ নিয়ে নির্বাচনের সময় ঝগড়ায় পিটুনিতে মাহবুব আহত হয়। সে ঘটনায় যে মামলা দায়ের করা হয় সেখানে ইসহাক ভাই বা আমাদের নাম ছিলো না। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও একটি বেসরকারি হাসপাতালে দুই মাস চিকিৎসার পর সে ভালো হয়ে যায়। বাসায় চলে আসে। সুস্থ হয়ে আসার সাত মাস পর সে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পরপর তাকে চিকিৎসা করা হয়নি। আক্রান্ত হওয়ার পাঁচদিন পর তাকে প্রথমে ঢাকার প্যান প্যাসিফিক হাসপাতালে ও পরে যাত্রাবাড়ির ডেল্টা হেলথ কেয়ার সেন্টারে ভর্তী করা হয়। ডেল্টাতে তার মৃত্যু হয়। সেখানকার ডাক্তারদের দেয়া ডেথ সার্টিফিকেট আমাদের কাছে রয়েছে। (তিনি এ প্রতিবেদককে সে কাগজ দেখান।) কিন্তু এই মৃত ব্যাক্তিকে রতন মিয়া ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে টাকা দিয়ে সুরত হাল ও পোষ্ট মার্টেম করিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। তিনি বলেন, এ হত্যা মামলা দায়েরের পর থেকেই তারা আমাদের বাড়ি ঘরে হামলা চালাচ্ছে। পুলিশ আমাদের কথাগুলির তদন্ত না করে তাদের কথার উপরই কাজ করছে। তারা নিজেদের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে থানায় গেলেই মামলা নিচ্ছে। কিন্তু তারা আমাদের বাড়িঘরে হামলা করলেও আমাদের মামলা নিচ্ছেনা। তারা ফোন করলেই গ্রামে চলে আসছে। আমরা ফোন করলে আসছে না। আমাদের বাড়ি ভাংচুরের মামলায় একটা মামলা নিয়েছে কিন্তু মামলায় রতন আর তার প্রধান সহযোগি ইউপি মেম্বার সাইফুলের নাম বাদ দিতে বাধ্য করেছে।
এ ব্যাপারে সোনারগাঁ থানার ওসি মনিরুজ্জামান পুলিশের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ অস্বিকার করে জানান, একটি হত্যা মামলার পাল্টা হিসেবে মামলা করতে আসায় ইসহাকদের মামলাগুলি নেয়া হচ্ছে না। কারণ বাদিপক্ষের অভিযোগ হত্যা মামলায় আপোষে বাধ্য করতে বাকি ঘটনাগুলি ঘটানো হচ্ছে। ডেঙ্গুতে মৃত্যুর অভিযোগ তদন্তের বিষয়ে তিনি বলেন, হত্যা মামলাটি তদন্ত করছে গোয়েন্দা পুলিশ।
মামলার তদন্তে থাকা গোয়েন্দা পুলিশের এসআই এস এম শরিফুল ইসলাম বলেন, ময়না তদন্তের রিপোর্টে হত্যা থাকায় আমরা হত্যা মামলার ধারায় এটি তদন্ত করছি।
ডেঙ্গুতে মারা যাওয়ার বিষয় সম্পর্কে তিনি বলেন, এ ধরনের কোনো অভিযোগ আমরা পাইনি।