একটি শহীদ মিনারের গল্প

 

ড. জেবউননেছা, প্রেসবাংলা২৪ডটকম: ছোটবেলা থেকে আমার পরিবারের শিক্ষা ছিল মুুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিশ্রদ্ধা প্রদর্শন করা। আশি দশকে আমার আব্বু কবি মুঃ জালাল উদ্দিন নলুয়া’র লেখা ‘টাকার পাহাড় চাই ’নাটকের সংলাপ ছিল, জন্মদাতা কর্মদাতা, শিক্ষাদাতার মতোই আমি ভালোবাসি শ্রদ্ধা করি দেশের মুক্তিদাতা ও মুত্তিযোদ্ধাদের। সেই সংলাপই আমার চিন্তা ভাবনার পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়। এসএসসি উত্তীর্ন হবার পর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণার কাজ। ১৯৯৫ এর দিকে নারায়ণগঞ্জের আমার জন্মস্থান নলুয়া’র মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার তমিজউদ্দিন কাকার কাছ খেকে সাক্ষাৎকার গ্রহণের মধ্য গিয়ে আমার যাত্রা শুরু হয়। তারপর থেকে থেমে থাকিনি মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত বিভিন্ন গ্রন্থ সম্পাদনা করেছি এবং এক যুগের ও বেশী সময় ধরে যুক্ত আছি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সাথে।

তারই ধারাবাহিকতায়, গবেষণা করতে গিয়ে অবহিত হই ১৯৭১ এ ঢাকায় যে কয়টি বিদ্যালয় খুলেছিল, ধানমন্ডি সরকারী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়টি খুলেছিল সবচেয়ে পরে । এই বিদ্যালয়ে ১৯৭১ এ পাক বাহিনীর ঘাঁটি ছিল। সঠিক ইতিহাস বের করে আনার জন্য। বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে ১৯৭১ এর সময়কাল শিক্ষকের সাথে যোগাযোগের জন্য তথ্য খুঁজে বের করলাম। স্কুলের শিক্ষিকা রুমি আক্তার যিনি বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন। তিনিও শুনেছেন, ১৯৭১ এর সময়কাল ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা। তার কাছ থেকে সংগ্রহ করলাম, প্রাক্তন ছাত্রীদের প্রকাশিত স্মরণিকা। যে স্মরণিকায় খুঁজে পেলাম ৬০ এবং ৭০ দশকের ছাত্রীদের মুঠোফোন নম্বর। যোগাযোগ শুরু করলাম তাদের সাথে।

২৮.০৩.২০১৭ইং তারিখে ১৯৭১ এর সময়কাল বিদ্যালয়ের একমাত্র জীবিত শিক্ষক নূরে মহল ম্যাডামের সাথে দেখা করি ঢাকার পশ্চিম কাফরুলে তাঁর বাসায়। তিনি আমাকে ১৯৭১ এর ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার কথা বর্ণণা করেন। ০২.০৪.১৭ইং তারিখে জেলা প্রশাসক ঢাকা অফিসে গেলাম। সেখানে গিয়ে জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সাথে সাক্ষাৎ করলাম । তিনি বললেন, আমাকে একটি আবেদন করার জন্য। জেলা প্রশাসক ভবনের পাশে অবস্থিত কম্পিউটারের দোকান থেকে কম্পোজ করে আবেদন করলাম। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পত্রের মাধ্যমে অবহিত করে এবং প্রকল্পে অন্তর্ভূক্ত করার জন্য অনুরোধ করে। আমি পরদিন পত্রটি নিয়ে নিজে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে যাই। সেখানে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মাননীয় মন্ত্রী জনাব আ.ক.ম মোজাম্মেল হক এমপি মহোদয়ের সাথে সাক্ষাৎ করি। তিনি মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয়কে নির্দেশ প্রদান করেন। প্রকৃত তথ্য যাচাই বাছাই করে প্রকল্পে অন্তর্ভূক্ত করার জন্য । শুরু হয়, আমার অপেক্ষা। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, এই গবেষণাকালীন সময়ে একদিন রাতে স্বপ্নে দেখতে পাই একজন নারী কার কোকঁড়া চুল এবং বড় বড় চোখে খালি একটি এলুমিনিয়াম থালা আমার সামনে এনে আমাকে বলচে ‘দে’ ‘দে’। এই স্বপ্নটি আমার গবেষণার গতিকে তরান্বিত করে। কেন যেন মনে হচ্ছিল,সত্যি এই বিদ্যালয়ের মাটির নীচে চাপা পড়ে আছে নির্মম ইতিহাস। যার হয়ত কোন প্রতিবিম্ব স্বপ্নে এসেছে আমার কাছে। যদিও স্বপ্ন কেউ বিশ^াস করতে চায়না। কিন্তু এই স্বপ্নটি আমাকে বিশেষভাবে প্রেরণা প্রদান করেছে।

 

১৭.১০.২০১৭ইং তারিখে এক্সিকিউটিভ কমিটি অন ন্যাশনাল ইকোনমিক কাউন্সিলে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণ প্রকল্পে ধানমন্ডি সরকারী বালিকা বিদ্যালয়কে অন্তর্ভূক্ত করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুমোদন প্রদান করেন। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে শুরু হয় বিদ্যালয়টিতে শহীদ মিনার তৈরীর কাজ। ২০১৮ সনে ডিসেম্বর মাসে লাল সবুজ বৃত্ত সম্বলিত শহীদ মিনার তৈরীর কাজ সম্পন্ন হয়। যে শহীদ মিনারের প্রধান ফটকে ইতিহাস লিপিবদ্ধ রয়েছে এভাবে, ‘১৯৭১ এ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ৩১ আর্টিলারী ফিল্ড রেজিমেন্টের এই ক্যাম্পটিতে পাক হানাদার বাহিনীরা রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে নারীদের এনে বিদ্যালয়ের ছাত্রীনিবাসের অতিথি কক্ষে নির্যাতন করে বিবস্ত্র করে রাখত এবং ঐ কক্ষ থেকে একজন নারী জানালা দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন বলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী জানালাটিতে ইট গেঁথে বন্ধ করে দেয়। বিদ্যালয়ের অডিটোরিয়ামের মঞ্চের পেছনে গ্রীণ রুমে ও নারীদের উপর নির্যাতন চালাত। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তীতে বিদ্যালয়ের গ্রীন রুমের পেছনে সজনে গাছের তলায় অনেক চুল এবং নারীদের ব্যবহৃত জিনিস পাওয়া যায়। নিরীহ মানুষদের ধরে এনে ব্রাশ ফায়ার করে বিদ্যালয়ের মাঠে গর্ত করে লাশ মাটি চাপা দিত এবং এক ধরনের রাসায়নিক পাউডার গর্তে দিয়ে দিত যেন মৃতদেহ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান এবং মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ড. জেবউননেছা উক্ত বিষয়টি অনুসন্ধান করেন। ’

 

এভাবেই পুর্ণ হয় আমার একটি স্বপ্ন। বিদ্যালয়ের অতিথিনিবাস যেটি ‘টর্চার সেল’ ছিল সেটি এখনো আছে। যদিও টর্চার সেলটি পরিত্যক্ত অবসস্থায় আছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারে নিকট আকুল আবেদন টর্চার সেলটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য। যা ইতিহাসের নীরব স্বাক্ষী হয়ে আছে। আছে গ্রীনরুমটি ও । তবে নেই সজনে ডাটার গাছটি। বিশাল মাঠটি রয়েছে। এই মাঠের মাটির নীচে মানুষের বোবা হাহাকার এতদিন নীরবে সহ্য করেছে বোবা মাটি। কিন্ত ইতিহাস চাপা থাকেনা। সূর্যের আলোর মতো বেরিয়েছে এতদিনের চাপা ইতিহাস।

 

 

১৯৭১ এর স্মৃতি বিজড়িত এই বিদ্যালয় নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে আমি বহু প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছি। তারা সবাই আমাকে সাধ্যমতো তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন। কৃতজ্ঞতা রইল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যিনি অত্র বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠার জন্য অনুমতি প্রদান করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নতুন আর একটি মাত্রা সংযোজন করে দিলেন। ঝড়ে-বৃষ্টিতে এই শহীদ মিনার মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকবে। পাক হানাদার বাহিনীর নিমর্মতার স্বাক্ষী হিসেবে বিদ্যালয়ের বুকে দাঁড়িয়ে থাকবে নির্যাতিত মানুষের প্রতিবাদ হিসেবে। আহবান করবে অনাগত প্রজন্মকে, হার মানা যাবে না, পরধীনতায়, মুক্তি নয়, মুক্তি স্বাধীনতায়।

 

এই শহীদ মিনার অনাগত প্রজন্মকে আহবান করবে —

‘ওরা ঘুমিয়ে আছে,ওদের ঘুমোতে দাও।
পথশ্রান্ত ওরা,নিদ্রার গহবরে ওদের বিশ্রামের দরকার
আমাদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্যে
ওরা ওদের বর্তমানকে উৎসর্গ করেছিল অসীম সাহসিকতায়,
ওরা ঘুমিয়ে আছে,ওদের ঘুমোতে দাও
আমাদের চোখের পাতা কোনো কুহকে বুজে এলে চলবেনা আজ’।

 

 

লেখক: ড. জেবউননেছা
সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, লোকপ্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

 

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com