রিফাত হত্যা মামলার তদন্তে প্রভাব খাটাচ্ছেন সাংসদ পূত্র সুনাম দেবনাথ !
প্রতিবেদক, প্রেসবাংলা২৪ডটকম: রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ড এবং মিন্নির গ্রেফতারের পর বরগুনায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন সুনাম দেবনাথ । অভিযোগ রয়েছে , তিনি তার পিতার রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে মামলার তদন্তে নানা রকম প্রভাব খাটাচ্ছেন।
এমন অভিযোগও রয়েছে যে মিন্নিকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে নিহতের বাবা দুলাল শরীফকে দিয়ে সংবাদ সম্মেলন করিয়ে ক্ষান্ত হননি সুনাম দেবনাথ। মিন্নির গ্রেফতারের দাবিতে বরগুনা শহরে তার উদ্যোগে সমাবেশও হয়েছে। সুনাম দেবনাথ নিজেও সেখানে উপস্থিতি ছিলেন। তার অনুসারীরা ফেসবুক এবং ইউটিউবে এ হত্যাকাণ্ডকে নানাভাবে ‘নারীঘটিত বিষয়’ হিসেবে প্রমাণের যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। যা সবাইকে বিস্মিত করেছে, তাহলো মিন্নিকে গ্রেফতারের পরদিন যখন আদালতে উপস্থাপন করা হয়, তখন তার পক্ষে বরগুনায় কোন আইনজীবী পাওয়া যায়নি।
মিন্নির পিতা বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, মেয়ের পক্ষে আদালতে দাঁড়ানোর জন্য তিনি তিনজন আইনজীবীর সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। এদের মধ্যে একজনকে তিনি টাকাও দেন। কিন্তু তাদের সবাই শেষ মুহূর্তে অপারগতা প্রকাশ করেছেন।
স্থানীয় সংসদ সদস্যের পুত্র সুনাম দেবনাথ নিজে বরগুনার একজন আইনজীবী। গত ২৭শে জুন তিনি তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছিলেন, “আমরা বরগুনার আইনজীবীরা রিফাত শরীফ হত্যাকারীদের কোন আইনি সহায়তা দিব না, একজনকেও না। আশাকরি আমার এই প্রস্তাবের সাথে সকল আইনজীবীরা একমত হবেন।”
মিঃ দেবনাথের এই ফেসবুক পোস্ট আইনজীবীদের উপর এক ধরণের চাপ তৈরি করে বলে জানিয়েছেন কয়েকজন আইনজীবী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বরগুনার একজন সিনিয়র আইনজীবী বিবিসি বাংলাকে বলেন, মিন্নিকে যেদিন আদালতে উপস্থাপন করা হচ্ছিল সেদিন মিঃ দেবনাথের অনুসারীরা আইনজীবীদের ”অহেতুক ভিড় না করার” পরামর্শ দেন। “তখনই আমরা বুঝতে পারলাম যে বিষয়টা কোন দিকে যাচ্ছে,” বলছিলেন ওই আইনজীবী। তার মতে, আইনজীবীদের অনেকেই নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত।
সম্প্রতি কুমিল্লায় আদালতের ভেতরে একটি হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ করে তিনি প্রশ্ন তোলেন , “যে দেশে বিচারকের সামনে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, সেখানে আমার জীবনের নিরাপত্তা কোথায়?” রিফাত হত্যাকাণ্ডের পর আলোচনা জোরদার হতে থাকে যে এই অপরাধের মদদদাতা কারা? রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার জন্য যারা প্রত্যক্ষভাবে দায়ী বলে অভিযোগ উঠেছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজীসহ ১৬ জন। বরগুনা শহরে মাদকসহ নানা অপরাধ তৎপরতার সাথে তাদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। এই অপরাধী চক্রের পেছনে রাজনৈতিক মদদ ছিল।
এই অপরাধী চক্রের বেশ কয়েকজন সদস্য মাদকের মামলায় কারাগারে গেলেও তাদের বেশি দিন আটকে রাখা সম্ভব হয়নি। এবং রাজনৈতিক প্রভাবেই তারা জেল থেকে বের হয়ে দ্বিগুণ উদ্যমে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, বরগুনা শহরে এমন অভিযোগ বেশ জোরালো।
বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, কেঁচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে আসতে পারে, এমন আশংকা থেকেই মামলাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা । বরগুনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জুবায়ের আদনান অনিক প্রশ্ন তোলেন, “মাদকটা কে চালায়? মাদকের পিছনে কারা জড়িত? এই যে নয়ন কাদের প্রশ্রয়ে এতদূর এসেছে?”
বিষয়গুলো নিয়ে সুনাম দেবনাথের সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হননি। বিবিসি বাংলাকে সুনাম দেবনাথ বলেন, “কয়েকটা মিডিয়া এরই মধ্যে এ ঘটনায় আমাকে ভিলেন বানিয়েছে। সেজন্য এই মুহূর্তে কোন সাক্ষাৎকার দিতে চাচ্ছি না।”
বরগুনার রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই বেশ প্রভাবশালী ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু। তবে দলটির নেতারা বলেছেন, তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের কিছুদিন পর থেকে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা তাঁর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের অনেক নেতা এখন মিঃ শম্ভুর বিপক্ষে। কয়েক বছর আগে বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের বেশ কিছু নেতা একত্রিত হয়ে মিঃ শম্ভুর বিপক্ষে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে অভিযোগও দাখিল করেছেন।
একজন সংসদ সদস্য হিসেবে বরগুনার প্রশাসনে তাঁর প্রভাব থাকলেও বরগুনা আওয়ামী লীগে তিনি অনেকের কাছেই অপছন্দের পাত্র। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র নেতা বলেন, দলের ভেতরে কিছুটা কোণঠাসা হয়ে যাবার পর আধিপত্য ধরে রাখতে অপরাধী চক্র গড়ে তোলেন মিঃ শম্ভুর ছেলে।
সেজন্য এই সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের কর্মকাণ্ড আড়াল করতেই রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডকে নারীঘটিত বিষয় হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নিজের নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে খুব কম মানুষই আগ্রহী বরগুনা শহরে। তবে তাদের ধারণা, রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডটি রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে বন্দী হয়ে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হচ্ছে।
বিষয়গুলো নিয়ে সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর সাথে বারবার কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তিনি টেলিফোন ধরেননি। সংসদ ওয়েবসাইটে তাঁর দুটো টেলিফোন নম্বর দেয়া আছে। এর একটি বন্ধ এবং অপরটি তাঁর স্ত্রী রিসিভ করে বলছেন যে তিনি বাড়িতে নেই। অভিযোগের বিস্তারিত জানিয়ে ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর দুটো মোবাইল ফোনে মেসেজ পাঠানো হলেও তিনি কোন উত্তর দেননি।
এর আগে সংবাদকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলেও দাবি করেছেন । আর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির দাবি করেছেন, এই মামলার তদন্তে কোন রাজনৈতিক চাপ নেই।