ড. জেবউননেছা, প্রেসবাংলা২৪ডটকম: নারায়ণগঞ্জে সাহিত্যাংগনে আমাদের বাড়ীতে আব্বু এবং দাদার ২৭.০৪.১৯৬২ইং তে পল্টন ময়দানে শেরেবাংলা এ.কে ফজলুল হকের জানাজায় অংশগ্রহণের একটি ছবি টাঙ্গানো ছিল। খাটিয়ার পাশে দাদার ছবি ছেলেবেলা থেকে আমাকে অনুসন্ধিৎসু করেছিল। তখন থেকেই আমার মধ্যে রাজনীতি,সংগ্রাম,আন্দোলন এ বিষয়ে আমার আগ্রহ তৈরী হয়েছিল । ছবিটি আমাদের বাড়ীতে আজ অবধি টাঙ্গানো রয়েছে। আব্বুর কাছ থেকে শুনেছি তখন শেরেবাংলার জানাজায় ভীড়ের মাঝে জনপ্রিয় গভর্নর আযম খানের এক পায়ের জুতো খুলে যায়। আমার দাদা লিয়াকত হোসেন কানু মিয়া সরদার ঢাকা জাজের জোরার ছিলেন এবং বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত এবং আন্তজার্তিক চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবি ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ (১৯৫৯) ছবির অভিনেতা ছিলেন। তিনি ১৯৪৭ সনের ৬ এবং ৭ জুলাই সিলেটের গনভোটে অংশগ্রহণ করেন।
আব্বু ২৪.৭.১৯৬৫ইং তারিখে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সদস্যপদ লাভ করেন। তখন চাঁদার হার ছিল ১২ পয়সা। আমার জেঠা প্রয়াত সালাহউদ্দিন আহমেদ (আব্বুর বড় ভাই) ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের একজন সদস্য ছিলেন। ১৯৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধে নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ার মাসদাইরে হেলাল কাকার বাড়ী (আব্বুর বড় ভাই) এবং বড় ফুপী রহিমা (আব্বুর বড় বোন) এর বাবুরাইলের বাড়ী হানাদার বাহিনী পুড়িয়ে দেয়।
বিশিষ্ট কলামিষ্ট এবং ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ওয়াহিদুল হক চাচা (আব্বুর মামাতো ভাই) ছিলেন ১৯৭১ এ ‘বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম শিল্পী সংস্থা’র অন্যতম উদ্যোক্তা এবং মুক্তিযোদ্ধা এনামুল হক চাচা (আব্বুর মামাতো ভাই) ‘বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম শিল্পী সংস্থা’র হয়ে কাজ করেছেন। ইয়াকুব আলী ভূইয়া চাচা (আব্বুর মামাতো ভাই) ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। জিয়াউল হক চাচা ( আব্বুর মামাতো ভাই) মিরপুরের নেতৃস্থানীয় নেতা ছিলেন। ৭১এ তিনি এ শহীদ হন এবং হাবিবুর রহমান ভূইয়া ভাই (আব্বুর ভাতিজা) একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
১৯৭০ এর নির্বাচনে অভূতপূর্ব বিজয়ে আব্বুর লেখা ‘জয় নৌকা’ শিরোনামে নাটিকাটি নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের তৎকালীন কার্যালয় বি.কে রোডস্থ কাঠের দোতলায় ১৯.১১.১৯৭০ইং তারিখে প্রচারিত হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রথম শহীদ ছাত্রনেতা ফারুক ইকবালের পাক হানাদার বাহিনীর গুলীতে রাজপথে ০৩ মার্চ,৭১ ই তারিখে শহীদ হবার পর ‘জয়বাংলা’ শিরোনামে আব্বু নাটিকা লিখেন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পাঁচ বছর পর আমার জন্ম। আশি দশকে যখন আমি স্কুলে পড়ি তখন বাংলাদেশের সত্যিকারের ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনে আমার ভাটা পড়েনি। শৈশব থেকে আমাদের বাড়ীতে মুক্তিযোদ্ধা,শিল্পী সাহিকিত্যকবৃন্দের আগমন এবং সংস্কৃতি চর্চার বলয়ে বেড়ে উঠার ফলে ইতিহাস ও ঐতিহ্য,দেশ,পতাকা,মুক্তিযুদ্ধ আমার কাছে ভীষণ পরিচিত বিষয় ছিল। যদিও পাঠক্রমে ছেলেবেলা বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তেমন কিছুই পড়ার সুযোগ পাইনি।
ছেলেবেলা আব্বুর লেখা ‘টাকার পাহাড় চাই’ নাটকের সংলাপ ছিল ‘জন্মদাতা,কর্মদাতা,শিক্ষাদাতার এবং মুক্তিদাতার মতোই আমি ভালোবাসি শ্রদ্ধা করি দেশের মুক্তিদাতা,মুক্তিযোদ্ধাদের। এই সংলাপটি হৃদয়ে ধারণ করে বেড়ে উঠেছি। নারায়ণগঞ্জে আমাদের সাহিত্যাংগনের বৈঠকখানায় ‘আমরা তোমাদের ভুলবনা শিরোনামে’ সাত বীরশ্রেষ্ঠের বিরাট ছবি আমার মধ্যে তৈরী করেছিল মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি চেতনা। সেই চেতনা থেকে সাহিত্য জগতে ক্ষুদে লেখক হিসেবে আমার পদার্পন ৩.৩.১৯৮৯ইং তারিখে আমাদের নারায়ণগঞ্জের সাহিত্যাংগনের ১৬ জন বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিকবৃন্দের সামনে আমার লেখা প্রথম কবিতা ‘রক্তে আকাঁ পতাকা’ শিরোনামে কবিতা পাঠ করে। ২.৫.১৯৯২ইং সনে নিজ হস্তে লেখা ‘শেখ মুজিবুর রহমান’ শিরোনামে আট লাইনের একটি কবিতা লিখি। তখন আমার বয়স ১২ বছর। ২২.৫.৯৪ইং তারিখ লিখেছি ‘৭১ এর কথা’ শিরোনামে প্রবন্ধ। ২৪.০৫.৯৪ইং তে ৭১ এর ঘটনা শিরোনামে আর একটি কবিতা লিখেছিলাম। শুধু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নয় মহান একুশ নিয়ে ও লিখেছি ২৬.৪.১৯৯২ই তারিখে ৪টি ছড়া এবং ২৪.৫.১৯৯৪ইং তারিখে লেখা ২১ শে ফেব্রুয়ারী নিয়ে কবিতা। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আব্বুর লেখা নাটক ‘রক্ত লাল পতাকা’ অভিনয় করতাম আব্বুর সাথে। ১১.০২.১৯৮৬ইং তারিখে নারায়ণগঞ্জের মিতালী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আয়োজিত শহীদ দিবসের আবৃত্তি প্রতিযোগিতা অংশগ্রহণ করে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলাম,তখন বয়স ছিল পাঁচ বছর।
নারায়ণগঞ্জ হাইস্কুলের শত বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে ‘শতবর্ষের আলোকে’ স্মরণিকায় প্রকাশিত আব্বুর লেখা ‘স্মৃতিপটে শহীদ রানা জালাল’ লেখাটি ছেলেবেলায়ই পড়া শেষ। ১৯৭৫ সালের ১৬ আগষ্ট আব্বুর লেখা ‘বঙ্গবন্ধু’ কবিতাটি জ্ঞান হবার পরই পড়া শেষ। আব্বুর লেখা একুশভিত্তিক নাটক ‘বাংলা আমার বাংলা’ ছেলেবেলায়ই পড়া শেষ। বর্তমানে এই কবিতাটি বঙ্গবন্ধু স্মুতি জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। আব্বুর বন্ধু রুণা প্রকাশনীর স্বত্তাধিকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কবি রুহুল আমিন বাবুল কাকার ‘মুক্তিযুদ্ধে আগরতলা’ গ্রন্থটি ছেলেবেলায় পড়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। কাকা আমাদের বাড়ীতে ৭০ দশক থেকে নিয়মিত সাহিত্য সভায় আসতেন। আব্বুর আর এক বন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশ বেতারের সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক জালাল উদ্দিন রুমী কাকা,৭১ এর ৭ মার্চ ঢাকা বেতারে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করতে না দেয়ায় সরকারী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সেদিন যারা ‘রেডিওর কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিলেন সেই আন্দোলনের রূপকার ছিলেন। রুমী কাকা আমাদের বাসায় নিয়মিত আসতেন। সাহিত্য জোটের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ফয়েজ আহমেদ কাকা আমাদের আমার নবম জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে এসেছিলেন। আব্বুর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘১৯৭১ এ নেতার ডাকে দেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ চলছিলো। তখন শত ইচ্ছে থাকা সত্তে¦ও অংশগ্রহণ করতে পারিনি। কারণ ঘরে তখন বিবাহযোগ্যা দুই বোন। তাদের নিরাপদে রাখা ও আমার জন্য একটি যুদ্ধ ছিল।’
এসকল ঘটনা থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ১২.০১.২০০১ইং তারিখে শীতলক্ষ্যা ইউনিয়নের কমান্ডার আমাদের মহল্লার বীর মুক্তিযোদ্ধা তমিজউদ্দিন কাকার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। এখানে একটি স্মৃতিকথা উল্লেখ করতে চাই, নারায়ণগঞ্জে স্বরবর্ণ প্রকাশনী আয়োজিত ২২আগষ্ট,১৯৯৭ শুক্রবার বিকেল তিনটায় আলী আহমেদ চুনকা পাঠাগারের শিশু বিভাগে জাতির জনকের স্মরণ সভায় একক কবিতা আবৃত্তি অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ কার্ডে উল্লেখ ছিল ‘তৎসঙ্গে অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষন জাতির জনকের স্মরণে ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক পরিবারের উত্তরাধিকারী কবি ও নাট্যকার মুঃ জালাল উদ্দিন নলুয়ার স্বরচিত কবিতা পাঠ’। উক্ত অনুষ্ঠান সভাপতিত্ব করেন আলহাজ¦ দাঈমউদ্দিন আহমেদ,ইউপি চেয়ারম্যান কাশীপুর ইউনিয়ন পরিষদ গোল্ড মেডেল পুরস্কৃত এবং জাতির জনকের নিষ্ঠাবান সেবক। অনুষ্ঠানটির আহবায়ক ছিলেন রমিজা রাজা। নারায়ণগঞ্জে এভাবেই মুক্তিযুদ্ধ চেতনা ধারনকারী পরিবার হিসেবে আমাদেরকে মূল্যায়ন করা হয়। মনে পড়ে,আব্বুর সাথে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ,ঢাকা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক কমান্ডে ১৪.৮ ১৯৯৮ইংতারিখে জাতীয় শোক দিবসে আলোচনায় নীলক্ষেত,বাবুপুরা আব্বুর সাথে গিয়েছিলাম। ২৪.১০.১৯৯৭ইং তারিখে ৫১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে ২৬ নং ক্রমিকে আব্বু ছিলেন ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক। এতো গেল দাদাবাড়ীর গল্প।
আমার নানাবাড়ী নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর থানার মদনগঞ্জে। নানাবাড়ীতে টাঙ্গিয়ে রাখা জাতির জনকের বড় ছবি শৈশব থেকে দেখেছি। আমার নানা সাহাবুদ্দিন চৌধুরী (সাহা মেম্বার) তৎকালীন নারায়ণগঞ্জের মদনগঞ্জের বন্দর থানা স্থানীয় আওয়ামী লীগের আমৃত্যু সদস্য ছিলেন। নানা বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাড়ীতে আসা যাওয়া করতেন নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সাথে। আওয়ামী লীগের চরম দুঃসময়ে দাঁড়ানো আমার নানার পরিবার এবং আমার মায়ের নানার পরিবার। ১৯৭১ এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য আমার নানা নারায়ণগঞ্জ থেকে রেসকোর্স ময়দানে গিয়েছিলেন। গিয়েছিলেন আমার মেজো চাচা ও। যাই হউক আওয়ামী লীগের সুসময় আসার পূর্বেই ১৯৯২ সনে নানা মারা যান । মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত নানা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে আত্মনিয়োগ করেছেন। তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য পরবর্তীতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ মন্ত্রী সাজেদা চৌধুরী নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের এক সভায় আসেন। উক্ত অনুষ্ঠানে নিবেদিতপ্রাণ আমার নানার প্রয়ানে একমিনিট নীরবতা পালন করা হয়। নানা চলে যাবার পরেও আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে পাশে থেকেছেন মামারা। বর্তমানে আমার ছোট মামা মোঃ আনোয়ার হোসেন নারায়ণগঞ্জ সদর থানার ১৯ নং ওয়ার্ডের শ্রমিক লীগের সহ সভাপতি। শহীদুল্লাহ মামা (মায়ের জেঠাত ভাই ) বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। বন্দর থানার মদনগঞ্জ এলাকার বিলুপ্ত বাওয়া জুট মিলের সর্বশেষ নির্বাচিত সিবিএ সভাপতি আফাজ উদ্দিন প্রধান নানা ( মায়ের মামা) ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা । বন্দর থানার সোনাকান্দা ইউনিয়নের আসাদ প্রধান নানা (মায়ের মামা) ৭০ দশক থেকে আমৃত্যু আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। নানা ভাইয়ের নানা বাড়ী নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়া মিউচুয়াল ক্লাবের পাশে,যেখানে আওয়ামী লীগের জন্ম। ৭১ এ হানাদার বাহিনী তাদের বাড়ী পুড়িয়ে দেয়। তখন তারা মদনগঞ্জে আমার নানা বাড়ীতে চলে আসেন। এ তো গেল নানা বাড়ীর গল্প।
এবার আমি যে গ্রামে জন্ম নিয়েছি সেই গ্রামের গল্প বলি। নারায়ণগঞ্জ সদর থানার নলুয়া গ্রামে আমার জন্ম। যে গ্রামে জন্ম নিয়েছেন প্রথিতযশা রাজনীতিবিদগণ। যারা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিলেন। শীতলক্ষ্যা ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের প্রথম সভাপতি তসদ্দক হোসেন এবং প্রথম সাধারণ সম্পাদক আলহাজ¦ মহিউদ্দিন আহমেদ খোকা দু’জনই নলুয়ার সন্তান ছিলেন। আলহাজ¦ মহিউদ্দিন আহমেদ খোকা ৬০ দশকে নারায়ণগঞ্জ সিটি আওয়ামী লীগের সম্পাদক এবং পরবর্তীতে ৭০ দশকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নারায়ণগঞ্জের কোষাধ্যক্ষ। তিনি ছয় দফা আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর সাথে একই জেলখানায় কারাবাস করেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা এবং সংগঠক ছিলেন। তিনি ৭১ এ নারায়ণগঞ্জ থেকে পলাতক মানুষগুলোর আশ্রয়, থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা এমনকি আগরতলাতে যাবার সুব্যবস্থা করেন।
১৯৬৬ সালের ছয়দফা সংগ্রামের প্রচারের গোপন সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল আমাদের বাসা থেকে ২ মিনিটের ব্যবধানে অবস্থিত নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জের বি.কে রোডস্থ মহিউদ্দিন আহমেদ (খোকা) র বোনের বর শফিউদ্দিন আহমেদ শরীফ মুন্সী সাহেবের বাসায়। উক্ত সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান,তাজউদ্দিন আহমেদ,মিজানুর রহমান চৌধুরী ( পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য) ,আলী আহমেদ চুনকা, এ. কে.এম.শামসুজ্জোহা সহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন ( ১২.০১.২০০১ইং তারিখে বীর মুক্তিযোদ্ধা তমিজউদ্দিন কাকার সাক্ষাৎকার থেকে)। বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’য় বেশ কয়েকবার মহিউদ্দিন আহমেদ খোকার কথা উল্লেখ রয়েছে। আলহাজ¦ মহিউদ্দিন আহমেদ (খোকা) আমাদের নলুয়া এলাকার সন্তান । তাঁর পরিবারের সাথে আমাদের তিন পুরুষের ধর্মীয় ও সামাজিক সম্পর্ক রয়েছে। আলহাজ¦ মহিউদ্দিন আহমেদ (খোকা) র বাবা আব্দুল আজিজ মিয়া আমার দাদীর উকিল বাবা ছিলেন। আলহাজ¦ মহিউদ্দিন আহমেদ খোকা আমার মেজো চাচার উকিল বাবা ছিলেন এবং তাঁর পুত্র নারায়ণগঞ্জের আলহাজ¦ ফয়েজউদ্দিন আহমেদ লাভলু (নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের প্রাক্তন সিনিয়র সহ সভাপতি) আমার মেজো চাচার মেয়ের উকিল বাবা। পরবর্তীতে খান সাহেব ওসমান আলী এম.এল এ সাহেবের নাতি নারায়ণগঞ্জের ৪ আসনের শামীম ওসমান, এমপি মহোদয়ের পুত্র অয়ন ওসমানের সাথে ফয়েজউদ্দিন আহমেদ লাভলু ( আমার কাকা) র কন্যার বিয়ে হয়।
নারায়ণগঞ্জের ষাট দশকের কবি ম. আ হাফিজ (নলুয়া’র সন্তান) তাঁর লাল লাল পলাশ গ্রন্থে লিখেন,নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক ইতিহাস যেদিন রচনা হবে,সেদিন নলুয়ার জনসাধারণের ভূমিকা লিপিবদ্ধ হবে। নলুয়া’র জনসাধারণ প্রতিকূল অবস্থার সংগ্রাম করে নারায়ণগঞ্জ শহরের নলুয়া রাজনৈতিক সচেতনতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত অম্লান রেখেছে।
তার মধ্যে তসদ্দক হোসেন ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য,নারায়ণগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি,ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। মহিউদ্দিন আহমেদ খোকা (ছয় দফা আন্দোলনের সংগঠক এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা)। এম.এ জাব্বার (আমার দাদার মামাতো ভাই),নারায়ণগঞ্জের সিটি আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক। এম. এ হালিম ( তসদ্দক হোসেন সাহেবের ভাতিজা)। তারা মিয়া,যিনি ৭১ এর পর খান সাহেব ওসমান আলী এম.এল এর সন্তান এ.কে.এম শামসুজ্জোহা একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন,সে পত্রিকার ‘বঙ্গকন্ঠ’ নামটি তিনি রেখেছিলেন। এই ব্যক্তিবর্গ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী,শেরেবাংলা এ.কে ফজলুল হক, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে রাজনৈতিক সখ্যতা ছিল। উক্ত রাজনীতিবিদগণ আন্দোলন সংগ্রামে নারায়ণগঞ্জে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন।
ষাট দশকের কবি ও নাট্যকার মুঃ জালাল উদ্দিন নলুয়া ১৯৮৭ইং সালে নলুয়া’র ইতিহাস সংক্রান্ত গ্রন্থ ঐতিহ্যের সিঁড়ি বেয়ে’তে লিখেছেন,‘নীতিতে অনড় অবিচল তসদ্দক হোসেন’। অপর আর এক অনুচ্ছেদে লিখেছেন ‘ভুলিনাই কারারুদ্ধ মহিউদ্দিন সাহেবের মৃত সন্তানের জন্য প্যারোলে আগমন’। ১৯৬৭ তে মহিউদ্দিন আহমেদ খোকা যখন কারারুদ্ধ তখন তার সন্তান জুয়েল মারা যান। তখন তিনি প্যারোলে আসেন। আর এক অনুচ্ছেদে লিখেছেন,‘নলুয়া ন্যাশনাল গার্ডের এক ঝাক পায়রা সিলেট গণভোটে খেটেছে দিবারাত্রি’।
আন্দোলন সংগ্রামে গর্জে উঠা নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক সচেতন গ্রাম নলুয়া এলাকায় আমার জন্ম। নারায়ণগঞ্জের যে বাড়ীতে আমার জন্ম হয়েছিল তার ঠিক পাশের জায়গাতে দীর্ঘদিন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগের কার্যালয় ছিল। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় তৎকালীন সিলেট অঞ্চলের দেশ বেছে নেবার অধিকার দেয়া হয়েছিল। সেই গণভোটে নলুয়া থেকে গিয়েছিলেন ন্যাশনাল গার্ডের ১৭ জন।
পিতৃকূল,মাতৃকূল এবং জন্মস্থানের গল্প অবতারণা করার কারণ হলো,একটি বিষয় পরিস্কার করার জন্য সেটি হচ্ছে আমার আদর্শে বঙ্গবন্ধু বাস করেন। চেতনায় মহান মুক্তিযুদ্ধ বিরাজ করে। অস্থিমজ্জায় বাংলাদেশ এবং অস্তিত্বে নারায়ণগঞ্জ বাস করে।
বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ার মিউচুয়াল ক্লাবে জন্ম হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলীম লীগের। বঙ্গবন্ধু রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু লিপিবদ্ধ করেছেন নারায়ণগঞ্জের নেতৃবৃন্দের কথা। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন ‘নারায়ণগঞ্জের কর্মীদের ত্যাগ ও তিতিক্ষার কথা কোনো রাজনৈতিক কর্মী ভুলতে পারে না (পৃ:২০০)’। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ এ সময়ে নারায়ণগঞ্জ মাথা নত করেনি কোন অন্যায়ের কাছে। নারায়ণগঞ্জ মানেই ভাষা আšেদালনের ইতিহাস, ছয়দফার ইতিহাস,একমুষ্ঠি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জ¦লজ¦লে ইতিহাস, ৭১ এর ইতিহাস। সেই চেতনা থেকে বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া প্রাচীন দলের সাথে আমাদের পরিবারের আত্মার সম্পর্ক দুঃসময়ে ছিল। শৈশব থেকে এই পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে একচুল বিচ্যুত হইনি। সেই চেতনা থেকে উদ্ধার করেছি ঢাকার ধানমন্ডি সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অজানা তথ্য। যে বিদ্যালয়ে এখন দাঁড়িয়ে আছে ‘মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ’।
মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের পরিবার হিসেবে কোনদিন মাথা নত করিনি বলে ব্যক্তিজীবনে ক্যারিয়ারের শুরুতে এবং পরবর্তীতে শিক্ষাক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। তবুও নইয়ে যাইনি। ছেলেবেলা ফিউরি খন্দকারের একটি কবিতা পড়েছিলাম,তুমি বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসো,আমি তোমাকে ভালোবাসব।’ এই কবিতাটি ছেলেবেলায় আব্বু শিখিয়েছিলেন। আব্বুর কাছ থেকে শুনেছি ১৯৬৪ এর দিকে নারায়ণগঞ্জের জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,তিনি তাঁর দলে ‘যখন যেমন,তখন তেমন’ লোক চাননা। ঐ নীতি নিয়েই বড় হয়েছি। আমাদের পরিবার ‘যখন যেমন,তখন তেমন’ পরিবার নয়। অকপটে বলতে পারি, বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে পুঁজি করে আজ পর্যন্ত আমার পিতৃকূলের এবং মাতৃকূলের কেউ কোন সুবিধা গ্রহণ করেনি। নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে গিয়েছি বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে। চেতনায় ধারণ করেছি মুক্তিযুদ্ধ।
বঙ্গবন্ধু,মুক্তিযুদ্ধ আমার কাছে একটি আবেগের নাম। যে আবেগ পুঁজি করে ব্যবসা করা যায়না। হীনস্বার্থ চরিতার্থ করা যায়না। যে আবেগ দিয়ে দল ভারী করা এবং ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের নামে সংকীর্ণতাকে প্রশ্রয় দিয়ে চালবাজি করা যায় না। যে আবেগ দিয়ে কবিতা,গল্প প্রবন্ধ লেখা যায়,শ্রদ্ধা করা যায়। আমার কাছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মানে,অন্যায়ের কাছে মাথা না নোয়ানো এক ব্যক্তিত্ব, অত্যাচারীদের খড়গ হবার ব্যক্তিত্ব, হার না মানা জয়ের মালা পরা এক ব্যক্তিত্ব। যাকে শুধু শ্রদ্ধা করা যায়।
ছেলেবেলোয় আশি দশকে আম্মুর লেখা ‘স্বাধীনতা’ শিরোনামে একটি কবিতা পড়েছিলাম,পরবতীর্তে ৯০ দশকে আম্মুর ‘অলংকার’ কাব্যগ্রন্থে ১০ পাতায় কবিতাটি প্রকাশিত হয়। স্বাধীনতা চিরঞ্জীব/ স্বাধীনতার নাম শেখ মুজিব। এই কবিতাই হৃদয়ে ধারণ করে বেঁচে আছি।
০৫.০৭.১৯৬৪ইং তারিখে বঙ্গবন্ধু নারায়ণগঞ্জ এসেছিলেন এবং দীর্ঘ সময় ধরে বক্তব্য রেখেছেন। সেখানে এক পর্যায়ে তিনি বলেছিলেন,‘আওয়ামী লীগ সংগ্রাম করেন দেশের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য। ভবিষ্যৎ বংশধররা যাতে গোলামে পরিণত না হয় আমাদের সংগ্রাম তাহার জন্যই।’ নেতা,আপনার এই কথাটি থেকেই শিখে নিয়েছি,যতই বাঁধা আসুক,নিজের ব্যক্তিত্বকে বিসর্জন দিয়ে যেন গোলামে পরিণত না হই। বাংলাদেশের কিংবদন্তী নেতাদের স্মেহধন্য নারায়ণগঞ্জ জেলা’র নলুয়া’য় জন্মগ্রহণ করে আমি নিজেকে ধন্য মনে করি। আমার আদর্শে বঙ্গবন্ধু, চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ,অস্তিত্বে নারায়ণগঞ্জ বিরাজ করবে আমৃত্যু। শেষ করব আব্বুর লেখা ঠিকানা কবিতা দিয়ে। যে ঠিকানা আমারও -
‘ব’তে বাংলা ভাষা হলো বেশ
‘ব’ তে বাংলা প্রিয় স্বদেশ,
‘ন’তে নারায়ণগঞ্জ সেরা জেলা,
‘ন’ তে নলুয়া আমার ঠিকানা।
লেখক: ড. জেবউননেছা
সহযোগী অধ্যাপক
লোক প্রশাসন বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
এবং
শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক
বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ক পরিষদ