বিধাতা, আবার ফিরে যেতে দিও শীতলক্ষ্যার তীরে : ড. জেবউননেছা

ড. জেবউননেছা , প্রেসবাংলা২৪ডটকম: লেখাটি যখন লিখতে বসেছি, তখন কোন কিছুই চোখের সামনে ভাসছেনা, ভাসছে একটিই স্মৃতি, আমার ব্যক্তিগত গাড়িটি রাজধানী ঢাকার সাইনবোর্ড অতিক্রম করে বিশ্বরোডের লিংক রোডে প্রবেশ করছে, আমি গাড়ির এসি বন্ধ করে দিয়ে জানালা খুলে দিয়েছি, একটি নির্মল চিরচেনা বাতাসের জন্য। যে বাতাসে বড় হয়েছি আমি। পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাইনা কেন, এ বাতাস শ্রেষ্ঠ বাতাস, শীতলক্ষ্যা নদীর বাতাস জন্মস্থান নারায়ণগঞ্জের বাতাস,গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে শহরের চাষাড়া, নিতাইগঞ্জের দিকে যেখানে আমার পূর্বপুরুষের ভিটে। আব্বু দাঁড়িয়ে আছেন আমার অপেক্ষায়। আমি গাড়ি থেকে নামার পরই আব্বুর দায়িত্ব গাড়িটিকে পার্কিং করছেন। বাসায় যাই। আম্মুর হাতের রান্না খেয়ে ছাদে উঠি। আম্মু তার গাছ দেখান,ফুল দেখান আর ফাঁকে ফাঁকে আমি দেখি শীতলক্ষ্যা। সময় কাটিয়ে ফিরে যাবার সময় আব্বু দাড়িয়ে থাকেন, ততক্ষণ তাকিয়ে থাকেন, যতক্ষন আমি অদৃশ্য হয়ে না যাই। আজ বড্ড বেশী মনে পড়ছে এই স্মৃতিটি।
আজ আমি চাইলেও যেতে পারছিনা, হাত বাড়ালেই শীতলক্ষ্যার বাতাস ছুতে পারছি না।আমার জন্মস্থান প্রিয় শহর আজ রাজধানি থেকে বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্নতা যেন হৃদয় চিড়ে যাচ্ছে।জীবনের এতটা সময় পাড় করলাম,এমন বিচ্ছিন্ন হতে দেখিনি।আমার দাদাবাড়ি,নানাবাড়ি সকল আত্মীয় স্বজন এই শহরটিতে বাস করেন।
একটি ক্ষুদ্র ভাইরাস, শুধু কি আমাকে আমার জন্মস্থান থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে।বিশ্ব থেকে বিশ্বকে বিচ্ছিন্ন করে তুলেছে।মৃত ব্যক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন করে তুলেছে, অর্থনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে তুলেছে। ব্যস্ত জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে তুলেছে। আজ লিখতে বসে অনুভব করছি, যারা মাতৃভূমি থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে আছেন, তারা কি করে বেঁচে আছেন? আমি ২০ কিলোমিটারের এই বিচ্ছিন্নতা মানতে পারছিনা আর তারা?
যাই হউক, লিখতে বসে কতরকমের ভাবনা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে কোনটা লিখব? কোন জায়গা থেকে শুরু করব?
গতকাল সামাজিক মাধ্যমে লিখেছিলাম,”আশা করি করোনামুক্ত বিশ্ব নোংরা রাজনীতি, চোগলখুরী, তেলবাজি, গীবত, দুর্নীতি মুক্ত হবে, নোংরা মানসিকতার পরিবর্তন ঘটবে’। লেখাটি লেখার পর, বিভিন্ন পর্যায় থেকে বিশিষ্টজনেরা নানারকম মন্তব্য করলেন,সেই মন্তব্যের সারবস্তু একটিই, সেটি সম্ভব নয়।
একজন তো লিখেই দিলেন,-‘ করোনা চলে যাবে একদিন, কিন্ত মানুষরূপী তেলবাজ, চাটুকার,স্বার্থপর, হিংসু টে, বিকৃত মানসিক্তার অমানুষদের এবং এদের পৃষ্টপোষকদের খাসলত যাবেনা- এটা ১০০%নিশ্চিত’।আর একজন লিখেছেন,কমপক্ষে তেলবাজি বন্ধ হউক, আর একজন লিখেছেন, করোনা পরিস্থিতিতে সকলের মাঝে মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত হউক, প্রকৃতি ও পরিবেশকে ভালবাসতে শিখুক’। আর একজন লিখলেন, আপা আমাদের দেশে হবেনা, হুইল, ডিটারজেন্ট দিয়ে ১০০ বার পরিস্কার করলেও হবেনা। ‘আমি প্রতিউত্তরে লিখি আমি আশাবাদী,ভোর আসবেই। সমাজবিজ্ঞান অনুষদের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি লক্ষ্য করেছি,এখনকার ছেলেমেয়েরা ভীষণ সচেতন, তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে, সাদাকে সাদা বলে, কালোকে কালো বলে। আমি এই প্রজন্ম নিয়ে ভীষণ আশাবাদী। আমিও ছাত্রজীবনে এতটা সচেতন ছিলামনা। যতটা সচেতন এখনকার ছেলেমেয়ে। এখনকার মতো প্রযুক্তি এত শক্তিশালী ছিলনা,সামাজিক মাধ্যম ছিলনা। এখন যত তাড়াতাড়ি দুর্নীতির খবর ছড়িয়ে পড়ে তখন এমন ছিলনা। পত্রিকাই ছিল একমাত্র মাধ্যম।
যাই হউক, সারাদিন ধরে ভেবেছি, কেন এদেশকে দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব নয়। যার যার স্থান থেকে সঠিকভাবে দায়িত্বটি পালন করলেই তো হলো। লোভ সংবরণ করলেই তো হলো।কেন সম্ভব নয়?
বর্তমানে জাবি ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রের অতিরিক্ত পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি,দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রতিদিন ক্যাফেটারিয়ার রান্নাঘর পরিদর্শন করতে হয়।রান্নাঘরে গেলেই বাবুর্চি, সুপারভাইজার ভদ্রতা করে বলেন, ম্যাডাম আজকে এই আলুর চপ টা করেছি, আপনি করতে বলেছিলেন, একটা খেয়ে দেখেন স্বাদ ঠিক আছে কিনা। আমি কুপন কাটি,তারপর স্বাদ পরীক্ষা করি।আর তাদেরকে বলে দেই, কোনদিন আমাকে বিনা টাকায় কিছু খেতে বলবেননা, আমি পছন্দ করিনা। ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রের অফিসে প্রথম যেদিন বসেছি, সেদিন পিয়ন এক কাপ চা নিয়ে এসেছে, আমি বলে দিয়েছি যদি ৯০ দিন দায়িত্ব পালন করি, আমাকে ৯০ দিন চা না দিলে ৯০ প্যাকেট টি ব্যাগ বেঁচে যাবে।দয়া করে চা দিবেননা।
বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণের পর কর্মচারীদের বলে দিয়েছি, আগামী তিন বছরে আমাকে চা দিবেননা। কর্মচারীরা বলেন, ম্যাডাম চা খাওয়ার জন্য ছোট একটি টাকা দেয়া হয় প্রশাসন থেকে।আর আমি বলি, অই টাকা দিয়ে অফিসের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কেনা যাবে। অদ্যাবধি তাই করে যাচ্ছি। ওদিকে আমার এক কর্মচারী সেদিন বলতেছিলেন, ম্যাডাম এই যে আপনি এত কৃচ্ছতা করেন, আপনার এসব বিষয়গুলো আমরা ছাড়া আর কে মনে রাখবে।আর আমি বলি,এটাই প্রাপ্তি আমার। আর এক কর্মচারী সে ভাল রান্নায় পারদর্শী। তার আক্ষেপ, বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর কেন তাকে আমার বাসায় রান্না করতে ডাকিনি। আজ পর্যন্ত আমার ব্যক্তিগত কোন কাজে কোন কর্মচারীকে আমি ব্যবহার করিনি, নির্দ্বিধায় বলতে পারি। এই এতটুকু সৎ সাহস আছে।এপার্টমেন্টের দারোয়ান দিয়ে কোনদিন ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করিনি।
ওদিকে আমার সহোদর দেশের নামকরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে চাকরি করে।চাইলে সে নিজের আত্নীয় স্বজনকে চাকরির সুযোগ করে দিতে পারে।অদ্যাবধি সে এটা করেনি। আমার কাছে তার প্রতিষ্ঠানে চাকরি লাভের আশায় ধর্না দিয়েছে অনেকে।আমি বলে দিয়েছি,সে আমার ভাই।কিন্ত এ বিষয়ে আমি তাকে অনুরোধ করবনা এবং আমি ও ব্যক্তিগতভাবে সেটা পছন্দ করিনা।কারণ, আমি এবং আমার ভাই চাকরিক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি ঘৃনা করি।আমরা স্বজনপ্রীতি করে চাকুরীতে প্রবেশ করিনি। আমরা চাইনা, কেউ পিছনের দরজা দিয়ে মেধা যোগ্যতাকে বুড়ো আংগুল দেখিয়ে চাকুরিতে প্রবেশ করুক।আমার বাবা সরকারি চাকরিজীবি ছিলেন, আমার বাবার সততাই ছিল সম্পদ। সেখান থেকে শিখেছি,দুর্নীতি নয় সততাই হউক আমার শক্তি।
শৈশবে আব্বু শিখিয়েছিলেন, তুমি কেমন তা বিচারের ভার যদি তোমার অফিসের কর্মচারীবৃন্দ, গৃহপরিচারিকা, ব্যক্তিগত গাড়িচালক, দারোয়ান তারা যদি সনদপত্র দেয় তুমি ভাল, তাহলেই তুমি ভাল। সেই যে শিখেছি আর ভুলিনি। আর সেই শিক্ষা থেকে ফল ও পেয়েছি অনেক। দশ বছর আগে গৃহপরিচারিকা, ব্যক্তিগত গাড়িচালক ফোন করে খবর নিয়ে জানতে চায় কেমন আছি। এই উদাহরণটি টানার জন্য পাঠক আমাকে ভাববেননা, আত্মপ্রচার করছি। কয়েকটি ঘটনা বর্ণনা করতে চাই।
ঘটনা -১ বেশ কয়েকদিন পূর্বে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির গাড়িচালকের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল, সে কথার ফাঁকে বললেন, ম্যাডাম,জানেননা, স্যার তো বড় পদ পাবার জন্য সারাক্ষন বড় বড় মানুষের কাছে ধর্না দিতে থাকে। আর ও কত ঘটনা কত কি। আমি চুপ করে শুনি।
ঘটনা -২ কোন একটি অফিসের পিয়ন দুর্নীতি করে গাড়ি কিনেছে, কিন্ত সে সেই গাড়ি নিয়ে অফিসে আসতে পারেনা, অফিস থেকে নিরাপদ দুরত্বে গাড়ি পার্কিং করে সে অফিসে যায়।
ঘটনা -৩ ততবড় কর্মকর্তা নন, তারপরও বাড়ি পর্যন্ত ফ্রিজ, টেলিভিশন, ডায়মন্ডের হার আর ও কত কি তার বাড়ি চলে আসে।
ঘটনা-৪ কোন একটি গ্রুপের বন্ধুরা মিলে দরিদ্রদের সাহায্য করবে বলে, কিছু খাবার কিনে। এক বন্ধুর বাড়িতে একজন লোক মারফত ১৭ প্যাকেট খাবার পাঠায়। সেই বন্ধুর বাড়িতে ১৭ প্যাকেট খাবার আসার পূর্বেই ৫ প্যাকেট সেই ব্যক্তি আগেই রেখে দিয়ে ১২ প্যাকেট নিয়ে আসে। জিজ্ঞাসা করলে সে বলে আসার সময় দুইজনের জন্য চার প্যাকেট রেখে এসেছি। অথচ সে অনুমতি না নিয়েই কাজটি করেছে।
ঘটনা -৫ কোন একটি প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন ধরে নিয়োগের ফাইল আটকে আছে।প্রতিষ্ঠান প্রধান এবং সংশ্লিষ্ট বোর্ডের সদস্যবৃন্দ মেধা এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে সেই নিয়োগটি সম্পন্ন করতে চান। কিন্ত বাধ সাধে গিয়ে অন্য জায়গায়। অদৃশ্য হাত এসে সেই কন্ঠরোধ করে দিয়ে সেই নিয়োগ প্রক্রিয়াটি বন্ধ করে দেয়ার নোংরা রাজনীতি করার প্রয়াস চালায়। লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসে। এসব ঘটনা দেখে।
এই হলো তথাকথিত মানুষের নোংরামি এবং দুর্নীতির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদাহরণ।
আজকে ছোট একটি কণাতুল্য ভাইরাস আমাদের জীবনকে একটা জায়গায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। গত কয়মাস ধরে। বন্ধ হয়ে গেছে বার, নাইটক্লাব, জাংক ফুডের দোকান। তাতে কি চলছেনা জীবন?
বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্র এখন প্রকাশ্যে আযানের অনুমতি দিয়েছে। এতে কি কার ও কোন ক্ষতি হচ্ছে? এই যে এখন দেশে দেশে আমিত্ব ছড়ানোর পারমাণবিক পরীক্ষা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, তাতে কি খুব ক্ষতি হচ্ছে?
কিসের এত বড়াই, কিসের এত লোভ? আজকে যারা মানুষকে ঠকিয়ে, দেশমাতাকে ঠকিয়ে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছে, তিনি যদি করোনায় আক্রান্ত হন, তাহলে তার লাশটা ও কেউ স্পর্শ করতে আসবেনা। চাইলেও দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করতে পারবেনা।কি লাভ?
আমার আব্বু সব সময় বলেন, বাংলাদেশের সব ধনীরা যদি নিয়মমাফিক যাকাত দিতেন, দেশে একটা ও গরীব থাকতনা।
আজকে এই দেশ কাদের জন্য শ্রমিকের, মজুরের, কামারের, কৃষকে র। আজ এই দুর্দিনে যাদের ঘরে চাউল নেই, ডাল নেই, তেল নেই তাদের পাশে দাঁড়ালে কি কমে যাবে? না কমবেনা। আমাদের দেশের মানুষের আত্মসম্মানবোধ অনেক, না খেয়ে থাকবে কিন্ত হাত পাতবেনা। তাদের দুয়ারে দুয়ারে এই করোনা বিপর্যয়ে দুমুঠো চাউল দিয়ে আসলে তারা এক আকাশ পরিমাণ খুশী হবে।
হ্যা করছে অনেকেই। মগবাজারের মোড়ে সব্জি পড়ে আছে,যার যার মতো নিয়ে যাচ্ছে।কেউ কেউ তহবিল গঠন করে সাধ্যমতো চেষ্টা করছে।কিন্ত যাদের এগিয়ে আসার কথা,তাদের তেমন কোন উদ্যোগ চোখে পড়েনি। করোনা আমাদের চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, অর্থ, বিত্ত, বৈভব কিছুই নয়।সম্প্রীতি, সমতায় মিলে মুক্তি। ঘুষ, দুর্নীতি নয় জনগনের সেবক হওয়াটাই মূল। কিছুই চিরস্থায়ী নয়, মানবিকতা আর সততার জয়গান চিরস্থায়ী।
আগে বাঁঁচবে মানুষ, তারপর অর্থনীতি,আগে জীবন তারপর জীবিকা।অর্থনীতির চালিকাশক্তি মানুষ। সেই মানুষগুলোকে বাচিয়ে রাখতে সামাজিক দুরত্বের বিকল্প নেই।
আমাদের মানসিকতার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটাতে হবে। নইলে মুখ থুবড়ে পড়বে বিবেক আর সভ্যতা। কয়দিন পূর্বে গণমাধ্যমে বলেছিলাম, এ সমাজ ভাংগা এত সহজ নয়। তাই আমি এই সমাজের রীতিনীতিকেই সম্মান করি। আমি জানি, যে সমাজ ভাংতে আমি পারবনা, অপারগ, সে সমাজ আমি কেন ভাংগার কথা বলব।
যে সমাজের দশ বছরের মেয়ে ত্রান আনতে ধর্ষিত হয়, সুযোগ পেলে শাড়ির সংখ্যা নিয়ে গবেষণা হয়,শাস্তির সমালোচনা করতে গিয়ে ছবি ব্যবহার করা হয়,নারী সংগঠনের প্রধান তাই সংগঠনের সমন্বয়হীনতার জন্য শুধু নারীকেই তুলোধুনো করা হয়। ভাষার মার্জিত প্রয়োগে যেখানে অনেকের সীমাবদ্ধতা সে সমাজে বাস করে নারী হিসেবে সম অধিকার চাইতে যাওয়া আমার কাছে সময় অপচয় মনে হয়। বরং এই সমাজে থেকেই নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে।কারন কেউ স্থান করতে দেয়না, স্থান করে নিতে হয়।
আমাদের সামাজিক মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। পরিবর্তন করতে হবে দৃষ্টিভংগির। যে কৃষক রোদে পুড়ে শস্য ফলান, তিনি আমার কাছে সম্মানের। যে শ্রমিক সূচের খোঁচা খেতে খেতে দেশের প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধিতে সাহায্য করেন, তিনি আমার কাছে সম্মানের। যে গৃহপরিচারিকা আমার ঘর মুছে দেন তিনি আমার কাছে সম্মানের। আর যিনি দুর্নীতি করে, রাজপ্রাসাদ গড়েছেন, তাকে সম্মান দূরের কথা, তার সাথে কথা বলাও আমার কাছে ভীষন অস্বস্তির।
এই প্রজন্ম আনবেই আলোকিত ভোর। একটি দেশের দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ শুধু সরকার নিশ্চিত করবেনা। সরকার একটি প্রতিষ্ঠান মাত্র। তার অংশ আমরা।প্রতিটি মানুষ যার যার জায়গা থেকে সৎ হই, তাহলেই তো হয়ে গেল। নিজের বিবেককে জাগ্রত করলেই তো হয়ে গেল। তবে আমি বিশ্বাস করি, ভাল মানুষের সংখ্যাই বেশি, দুর্নীতিবাজদের সংখ্যা কম।
অনেকে লিখছেন, করোনা ভাইরাসের কারনে এখন সড়ক দুর্ঘটনা কমে গিয়েছে এটা একটা সুসংবাদ। হ্যা তাইতো। কিন্ত এই সড়ক দুর্ঘটনা যেন না হয়, সেই নীতি প্রণয়ন করা উচিত।
আজকে প্রকৃতি জেগে উঠেছে, পাখিদের গানে সকাল হচ্ছে। কিন্ত কেন এতদিন পাখি গান গায়নি। প্রকৃতি মরতে বসেছিল। সেই কারণ খুজার মোক্ষম সময় এখনই।
দিনমজুর, মুটে, মুচি, ভ্যানওয়ালা, রিকশা ওয়ালা, গার্মেন্টস শ্রমিক দুর্নীতি করেনা, দুর্নীতি করে কারা? সেই প্রশ্নের উওর বের করে, যেখানেই দুর্নীতি সেখানেই প্রতিবাদ এই শ্লোগান ধারণ করে, দুর্নীতিবাজদের শিকড় তুলে ফেলার কাজটি কিন্ত আমার আপনার সকলের।
আজকের এই বিপর্যয়ে পুলিশ, প্রশাসন, স্বাস্থ্যকর্মী এবং গণমাধ্যম কর্মীবৃন্দ যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের জন্য শ্রদ্ধা রইল। অপরদিকে যারা সামান্য ত্রান দিতে গিয়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করছেন, তারা একটু ভাবুন, দান প্রচারের বিষয় নয়।
এক শ্রেণির মানুষ কি রান্না করছে বাসায়, সেই মুখরোচক ছবি প্রচার করছেন, তারা একটু ভাবুন তো আপনার খাবারের ছবিতে আপনার দীনতা প্রমান করছে কিনা। আপনি কি আপনার ৪০ বাড়ি পর্যন্ত খবর নিয়ে দেখেছেন, সবাই আপনার মতো ভাল খাবার পাচ্ছে কিনা। এখন রান্নার ছবি আপলোড করার সময় নয়। সৃষ্টিকর্তাকে ডাকার সময়। দান করার সময়। যদি দান করতে না পারেন, নীরব থাকেন, কিন্ত রান্নার ছবি দয়া করে দিবেননা।
যাই হউক শুরু করেছিলাম, নারায়ণগঞ্জের স্মৃতি দিয়ে,আব্বুর গল্প দিয়ে। শেষ ও করব আব্বুর একটা কথা দিয়ে,কয়দিন আগে আব্বু বলতেছিলেন, একটা বিষয় নাকি তার চোখে পড়েছে, যে বাড়িতে মেয়ে আছে,সে বাড়ির মেয়ের বাবা মা মারা গেলে কান্নার শব্দ শোনা যায়।ছেলেদের কান্নাকাটি বা তেমন মন খারাপ করতে দেখা যায়না। কথাটি শোনার পর থেকে মাঝে মাঝেই মন বিষন্ন হয়ে উঠে।আমার তো মেয়ে নেই। আমি মরে গেলে কি আমার ছেলে কাঁদবেনা?সর্বস্তরে মানবিকতার অভাব লক্ষ্যনীয়, করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য হাসপাতাল নির্মানে বাঁধা,কবরস্থানের প্রধান ফটকে লাশ দাফন না করার সিদ্ধান্ত ঝুলিয়ে রাখা, মাইলের পর মাইল হেটে আসার পর বাড়িওয়ালাদের বাঁধার মুখে ঘরে প্রবেশে বাঁধা আর ও কত কি। এই করোনা এত শিখাচ্ছে, অথচ মানবিকতা বোধ জেগে উঠছেনা কেন?
আজ ঘুম থেকে উঠেই একটি খবর খুব চোখে পড়ছে, ভারতে চার কন্যার কাঁধে বাবার লাশ। কেউ আসেনি সে বাবাকে সৎকার করতে। তারাই সব করেছে। এই খবরটি ভীষণভাবে আমাকে আবেগাপ্লুত করেছে। ছেলে বা মেয়ে নয়, দায়িত্ব পালনটাই মুখ্য। ওদিকে আমার বাসার গৃহপরিচারিকা ১৯ বছর সংসার করে বাড়ি ছেড়ে এসেছে, স্বামীর অত্যাচারে, কেন সে পুত্র সন্তানের মা হতে পারেনি, দুইটি কন্যা সন্তানের মা। এই হলো দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের।
সর্বস্তরে গ্রামের বাড়ির রান্নাঘর, গোয়ালঘর, খড়ের গাদা থেকে শুরু রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত দৃষ্টিভংগির সংস্কার করতে হবে। তাতেই মিলবে মুক্তি। এখন শুধু প্রার্থনা, করোনা মুক্ত হউক পৃথিবী।
করোনামুক্ত হউক প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। করোনামুক্ত হউক আমার জন্মস্থান প্রাচ্যের ড্যান্ডি নারায়ণগঞ্জ। শীতলক্ষ্যার পরশ পাবার জন্য মন অস্থির হয়ে আছে। আব্বু আম্মুকে ছুঁয়ে দেখার জন্য মন ছুটে যাচ্ছে। হে আল্লাহ পাক পরোয়ারদিগার, দয়ার সাগর, তুমি সবাইকে সুস্থ রাখো। আমাদের করোনামুক্ত করে দাও।
ড. জেবউননেছা
সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
লোক প্রশাসন বিভাগ।
জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়