সৃষ্টিকর্তা ‘করোনা’ যুদ্ধে জয়ী করে দিন
ড. জেবউননেছা, প্রেসবাংলা২৪ডটকম: কয়দিন ধরে, লিখতে বসি, করোনা নিয়ে মানসিক অস্থিরতার কারণে আবার উঠে যাই, লেখা আর হয়না। আজ একরকম মনের বিরুদ্ধেই লিখতে বসলাম।কিন্ত শুরু করব কোথা থেকে ভেবে পাইনা,কোন দেশ থেকে শুরু করব, কোথায় গিয়ে থামব।যাই হউক, আজ সিদ্ধান্ত নিলাম লিখবই। একটি ঘটনা দিয়েই শুরু করা যাক, আমার বাসার ফটকের সামনে কয়েকদিন ধরেই দেখি একটি বিড়াল সকাল সাতটায়, দুপুর একটায়,বিকেলে এসে বসে থাকে।করোনার কারনে বাসার ভিতরে সিসিটিভি ক্যামেরায় যখন বিড়ালটিকে দেখা যায়, আমার ছেলে ঘর থেকে নিয়ে তাকে মাংস বা মাছ খেতে দেয়, আমি আমার ছেলের কাছে জানতে চাইলাম, এই বিড়াল কতদিন ধরে আসে? সে বলল, তা তো অনেক দিন ধরেই।আমি সাতটায় স্কুলে যখন যাই,তখন তাকে কিছু খেতে দেই আবার যখন একটায় ফিরি তখন তাকে খাবার দেই। এখনতো স্কুলে যাই না, কিন্ত বিড়ালটি সময়মত আসে।বিড়াল তো জানেনা,আমি ‘করোনা’র জন্য স্কুলে যেতে পারছি না।আমি বললাম, তুমিতো আমাকে বলোনি। সে বলল, সে আমার সাথে সাথে আসে আবার চলে যায়, আর তুমি তো তখন অফিসে থাকো।
কয়দিন থেকে বিড়াল কিন্ত সময়মতো ঠিকই এসে দরজার সামনে বসে থাকে। এই হলো একটি বিড়ালের কাহিনী।
চারিদিকে অস্থিরতা, শংকা, উদ্বেগ একটাই কারন-‘করোনা’। ক্ষুদ্র একটি ভাইরাস, যা পুরো বিশ্বকে তোলপাড় করছে। ধনী গরীব উচু নীচু কাউকে ছাড়ছে না। আমাদের ব্যস্ত জীবন আজ থমকে দাঁড়িয়েছে। সারাদিন ইচ্ছা অনিচ্ছায় চোখ পড়ে থাকে সামাজিক মাধ্যমে। সবার অনুভূতিতে চোখ বুলাই। নানা রকমের পরামর্শ, উপদেশ আর ও কত ঘটনা চোখে পড়ে।
রাতে কভিড -১৯ এর ট্র্যাকার দেখে ঘুমাই কতজন আক্রান্ত হলো, সকালে উঠে দেখি শত শত আক্রান্ত বেড়ে গিয়েছে।
ঘরের মধ্যে ছেলেটা এ ঘর ও ঘর করে, বারান্দাতে ও যেতে তার মানা। সে ছাদে খেলতে যেতে পারেনা,ঘরের মধ্যেই ফুটবল খেলে, ঘরের মধ্যে ক্রিকেট খেলে। একরকম বন্দী জীবনে আছে সে। মাঝে মাঝে দুশ্চিন্তায় শরীরে তাপ অনুভূত হয়, শ্বাস প্রশ্বাস ও নিতে কষ্ট হয়। পরক্ষনে ১০ সেকেন্ড বড় দম নিয়ে রাখি,এরপর নিশ্চিত হই, করোনা ভাইরাস এখনো খুঁজে পায়নি আমাকে। তবে খুঁজতে কতক্ষন। সে তো কাউকেই ছাড়ছেই না। দিন রাত উপায় খুঁজি বের হবার এই ভাইরাসের তান্ডব থেকে। খানিকপর অসহায় হয়ে যাই। নিজের ছায়াটাকে ও এখন অচেনা লাগে।
বাজার করতে গিয়েছি কয়দিন আগে, দোকানি বলছে ঈদেও এত বিক্রি হয়না, যত বিক্রি করছি, আমি শুনি আর হাসি, আমাদের বিবেকবোধ নিয়ে।যেখানে এক সেকেন্ডের ভরসা নেই, সেখানে খাদ্য মজুদ করি আমাদের মতোই বিবেবকবান মানুষেরা। বাসায় এই অবসরে ভাবি, যদি এতটাই অসহায় আর নিরুপায় আমরা, তাহলে কেন এত আয়োজন করি আমি বা আমরা? এই যে সংসার সাজিয়েছি কত পরিশ্রম করে,কি লাভ হলো? এত খ্যাতি, সুনাম, ছেড়ে যেতে হবে সব।এ বিষয়টি কেন এখন এতবেশি নাড়া দিচ্ছে? ছেলেবেলা থেকেই তো শিখেই বড় হলাম, মানুষ মরনশীল। তাহলে এই জানা বিষয় নিয়ে নতুন করে অনুভূতি কেন কাজ করছে? ‘করোনা’ আক্রান্ত মৃতব্যক্তিদের লাশের সৎকার দেখে? নাকি মৃত্যুর মিছিলে যাবার জন্য এখনি প্রস্তুত নই?
সারাদিন প্রার্থনা করতে করতে গলা শুকিয়ে যায়। ঘুমের মধ্যে ও তজবীহ জপতে থাকি।তাহলে এতদিন এমনভাবে কেন করিনি,কেন ভাবিনি?
ক্ষুদ্র একটি ভাইরাস, যার নাক, কান চোখ, হাত কিছুই নেই, সে শিক্ষা দিচ্ছে হাত ধুতে পরিস্কার থাকতে।
অথচ, সবাই জানি, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ। এখন বোধোদয় জাগ্রত হয়েছে আমাদের,একে অপরের কাছে ক্ষমা চাইছি।
কেউ কারো ছিদ্রান্বেষণ করছিনা, ক্ষতি করার চিন্তা ও করছিনা। গতকাল বিকেলে আমার সৌদী প্রবাসী বান্ধবীর সাথে কথা হচ্ছিল, ও বলল, আল্লাহ আমাদের তওবা করার সুযোগ দিয়েছেন, এটা আমাদের সৌভাগ্য। গতরাতে অসুস্থ বোধ করলে, তাকে বলি, আমার জন্য তুমি আমার নাম করে দু’রাকাত নফল নামাজ পড়ো বন্ধু, যেন আমি সুস্থ হয়ে যাই।ঘুম থেকে উঠে দেখি সে ক্ষুদে বার্তা দিয়ে রেখেছে, সে নামাজটা পড়েছে। কিন্ত এই বান্ধবী বহুবছর সৌদী থাকে কই কখনো তো বলিনি আমাদের মংগলের জন্য দুই রাকাত নামাজ পড়তে?
যুক্তরাষ্ট্রে আমার এক বন্ধু আছে,সে বলতেছে জেবা, সামনের দিন খুব কঠিন সময়ে যাব।পংগপালের আক্রমন,নাসা সতর্ক দিয়েছে বড় বড় পাথর পৃথিবীর দিকে আসছে।আর আমি বলি সাবধানে থাকো,আর সে বলে তোমাদের নিয়ে,বাংলাদেশ নিয়ে চিন্তা হয়, ‘করোনা’ তোমাদের করুনা না করলে কি বিপর্যয়ই না অপেক্ষা করছে।
ওদিকে আমার প্রাক্তন সহকর্মী যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমার খোজ খবর নিচ্ছে,আমাকে পরামর্শ দিচ্ছেন,আমি যেন ঠিকমত পানি পান করি,লেবুর রস পান করি আর ও কত কি।
এক খালামনি ইতালির রোমে থাকেন, তাকে নিয়ে আমরা চিন্তা করব কি, তিনিই চিন্তা করছেন আমাদের দেশ নিয়ে, আমাদের নিয়ে, অথচ তিনিও অবরুদ্ধ।
এক সহকর্মী জার্মানিতে আর একজন অস্ট্রেলিয়া, তারা অবরুদ্ধ অথচ বাংলাদেশ নিয়ে তাদের চিন্তার শেষ নেই। খবর নিচ্ছেন, বিশ্বের নানা প্রান্তে থাকা শুভাকাঙ্ক্ষীবৃন্দ। কেন এত চিন্তা তাদের আমাদের নিয়ে? তাদের কথা বাংলাদেশ কি প্রস্তুত? আমি চুপসে থাকি। কিছু বলার নেই।
কতটুকু প্রস্তুত আমরা? যেখানে মানুষ এখনো দেদারসে ঘুরে বেড়াচ্ছে।হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাচ্ছে।কোয়ারেন্টিনে থাকা রোগীদের দেখতে ভীড় জমাচ্ছে।আর ও কত তামাশা চলছে।কয়টা দিন একটু ধৈর্য ধরলে কি ক্ষতি হতো? এই যে এখন বার, নাইট ক্লাব, শপিং মল, জাংক ফুডের দোকান বন্ধ, জীবন কি চলছেনা আমাদের?তাহলে এত অস্থিরতা কেন? কিসের জন্য অবরুদ্ধ না হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সবাই? অথচ আমাদের ভবিষ্যৎ কোথায় যাচ্ছে জানিনা। একটু সচেতন হলে ক্ষতি কি?
না, আমরা জাতি হিসেবে কেমন যেন। শুধু সুযোগ খুঁজি। সুযোগে হুজুগের ঠেলায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করি। অথচ তারা জানেও না এই বিভীষিকায় তারা ও পড়তে পারে। তবে বেশিরভাগ অংশই যথেষ্ট মহানুভব এবং পরোপকারী। যারা এখনো নিজের কথা নয় দেশ ও দশের কথা ভাবেন। আজ এই ক্রান্তিলগ্নে ঢাল তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ নয়, সবাই মিলে করোনা যুদ্ধকে প্রতিহত করতে হবে মানসিক শক্তি দিয়ে।
অনেককে সামাজিক মাধ্যমে লিখতে দেখছি করোনা আশীর্বাদ। এরমধ্যে একজন লিখেছেন,
‘# সিরিয়ার ইদলিবে নতুন করে কোন যুদ্ধ শুরু হয়নি
# প্যালেস্টাইনে ইসরায়েলী পাষন্ডরা হামলা চালায়নি
# উইঘুরে মুসলিমরা নতুন করে নির্যাতিত হয়নি
# ইয়েমেনে নতুন কোন সংঘাত হয়নি
# আল কায়েদার নতুন অভিযান খবর শোনা যায়নি
# আইএস এর নতুন ধান্দা প্রকাশ পায়নি
# রাখাইনে নতুন রোহিংগা নির্যাতন হয়নি’।
( সংগৃহীত)
মিশরের একজন প্রাক্তন সংসদ সদস্য বলেছেন, করোনারভাইরাসকে ঘৃণা করবেন না। এটা মানবতা ফিরিয়ে এনেছে মানুষকে তাদের স্রষ্টার কাছে এবং তাদের নৈতিকতায় ফিরিয়ে এনেছে। এটি বার, নাইট ক্লাব, পতিতালয়, ক্যাসিনো বন্ধ করে দিয়েছে।এটি সুদের হারকে কমিয়ে এনেছে। পরিবারের সদস্যদের একসাথে নিয়ে এসেছে। অশ্লীল আচরণ বন্ধ করেছে। এটি মৃত এবং নিষিদ্ধ প্রাণী খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এখনও পর্যন্ত এর কারণে সামরিক ব্যয়ের এক তৃতীয়াংশ স্বাস্থ্যসেবাতে স্থানান্তরিত হয়েছে। আরব দেশগলোতে শিশা নিষিদ্ধ করেছে। করোনাভাইরাস মানুষকে দুআ করতে বাধ্য করছে। এটি স্বৈরশাসক এবং তাদের ক্ষমতাকে তুচ্ছ করেছে।
মানুষ এখন উন্নতি এবং প্রযুক্তির চেয়ে আল্লাহ/ইশ্বরের কাছে উপাসনা করছে। এটি কর্তৃপক্ষকে তার কারাগার এবং বন্দীদের দিকে নজর দিতে বাধ্য করছে। এটি মানুষকে শিখিয়েছে কীভাবে হাঁচি এবং কাশি দিতে হয়, যেমনটি আমাদের নবী সাঃ ১৪০০ বছর আগে শিখিয়েছিলেন, করোনাভাইরাস এখন আমাদের ঘরে সময় কাটানো, সহজ জীবনযাপন করা, অহেতুক প্রতিযোগিতা না করতে শিখিয়েছে। একই সাথে আমাদের চেতনা জাগ্রত করার জন্য এবং সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা ও সাহায্য প্রার্থনা করার সুযোগ দেওয়ার জন্য আমাদের ‘(সংগৃহীত)
আর একজন লিখেছেন-‘আসুন, আমরা আগামী দু-সপ্তাহ মাত্র তিনটে কাজ করি। বেশি না, তিনটে কাজ-
এক: বাইরে বেরোনো বন্ধ করে দিই। বন্ধ মানে বন্ধ। পাড়ার দোকানটুকুও নয়। আত্মীয় বন্ধু প্রতিবেশী কারোর বাড়ি যাবেন না, তাদেরও নিজের বাড়িতে ডাকবেন না। যেখানে ভিড় বেশি, কুড়ি জনের বেশি লোক জমায়েত হয়েছে সে জায়গা এড়িয়ে চলুন, সে শপিং মল হোক কি ধর্মীয় স্থান। দুসপ্তাহ সেদ্ধ ভাত খেয়েই চালিয়ে নিই। চাল-ডাল-আলু-পেঁয়াজ মজুত আছে এতদিনে। বিরিয়ানি মশলা কিনতে না বেরোনোর প্রতিজ্ঞা করি।
দুই: সাধারণ হাইজিন মেনে চলি। খাবার আগে বা এবং ঘন্টায় অন্তত একবার করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলি। নাকে-মুখে হাত যথাসম্ভব কম দিই।
তিন: ‘আমি একা কি করব? সবাই তো মানছে না’ – এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসুন। আপনার মাধ্যমে যদি একজনও ক্ষতিগ্রস্থ হয় সে হল আপনার প্রিয়জন। বাবা-মা-স্বামী-স্ত্রী-সন্তান। যার সঙ্গে আপনি দিনের বেশিরভাগ সময় কাটাচ্ছেন তাকে আপনিই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন না তো? বয়স্ক মানুষ ছাড়াও যাদের হাইপ্রেসার, সুগার, হার্টের অসুখ, কিডনি, ক্যান্সার বা অন্য কোনো সাধারণ ক্রনিক রোগ আছে, করোনাভাইরাসের সংস্পর্শে এলে তাঁদেরও মৃত্যুর হার কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
তিনটে বিষয়, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল বাইরে না বেরোনো। কতদিন না বেরিয়ে সম্ভব? ঠিক দু-সপ্তাহ। আপনি হয়ত স্ট্রং, সাধারণ ফ্লুও উপসর্গও নেই। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও আপনি ঠিক সুস্থ হয়ে যাবেন। কিন্তু চৌদ্দদিনের মধ্যে আপনি যদি কোন অন্য মানুষের সংস্পর্শে আসেন তাহলে তাঁর জীবন বিপন্ন হতে পারে। এটা ভেবে শিক্ষিত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ যদি এটুকু মেনে চলে তাহলেই আমরা নিরাপদ থাকব।আসুন দেখিয়ে দিই, প্রথম বিশ্বও যেটা পারেনি, আমাদের গরিব দেশ সেটা করে দেখি (সংগৃহীত)।
এই কয়টি বার্তা থেকে এতটুকু বুঝতে বাকি নেই,আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে মানুষ মানুষের জন্যই। আসুন সবাই করোনা’র কাছে করুনা না চেয়ে, করোনাকে প্রতিরোধ করি আমাদের সচেতনতা দিয়ে।
শুরু করেছিলাম বিড়ালের ঘটনা নিয়ে। লেখা যখন শেষ পর্যায়ে বাসার সিসিটিভি দিয়ে দেখতে পেলাম, বিড়ালটি আমার ছেলের স্কুল থেকে ফেরার অপেক্ষা করছে এক টুকরো মাছ অথবা মাংসের জন্য।
চোখটা বন্ধ করলাম আমি, আমার চোখে ভেসে এলো, প্রিয় ক্যাম্পাস, প্রিয় বিভাগ, প্রিয় শিক্ষার্থীদের কচিমুখগুলো, কবে দেখব তাদের। ভাবতে ভাবতে একটা শংকা কাজ করতে লাগল, আদৌ দেখতে পারব তো? নাকি তার আগে হেরে যাব, জানিনা।পারব কিনা, না পারি, প্রার্থনা তো করতে পারি, আমার প্রতিটি শিক্ষার্থীবৃন্দ যেন করোনার কাছে হার না মানে। তারা সবাই যেন আবার হাসিমুখে চঞ্চলতায় ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণকে মুখরিত করে। আমি আবার শ্রেনীকক্ষে ফিরতে চাই, শিক্ষার্থীদের কচিমুখ দেখতে চাই। আমার ছেলে নির্ভয়ে স্কুল যাবে, সেইদিন দেখতে চাই। স্কুলে যাবার সময় বিড়ালটিকে খেতে দিবে, ফেরার সময় খেতে দিবে, বিকেলে ছাদে খেলতে যাবার সময় খেতে দিবে সেই দিন চাই।
হউক আমার রাজধানী ঢাকা দূষণের, যানজটের। সেই দূষনেই, যানজটে নাকাল হয়ে বাড়ি ফিরতে চাই।সবাই মিলে সুস্থ হয়ে ‘করোনা’র বিরুদ্ধে লড়তে চাই। একসুরে বলতে চাই-এই বাংলাদেশ করোনাকে জয় করেছে। সেই সুর মেলানো সুখের দিনের প্রত্যাশা করতে করতে চাই। সারা বিশ্বকে নিয়ে একসাথে বাঁচতে চাই।
লেখাটি লিখতে লিখতে আব্বু ফোন দিয়ে খবর দিলেন, করোনার দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাবার জন্য পবিত্র কোরআন শরীফের ৩০ নম্বর পারা গত দেড় ঘন্টায় পড়ে শেষ করেছেন। কয়েকজন মিলে কয়দিন পূর্বে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলাম, করোনা থেকে মুক্তি পাবার জন্য পবিত্র কোরআনটি পড়ে শেষ করব। তারই অংশ হিসেবে আব্বু পড়েছেন ৩০ নম্বর পারা। সেই সাথে জানালেন, আমাদের বাড়ির ছাদে মধুমালতী গাছে বুলবুলি পাখি ডিম পেড়েছে। শুনে হতাশায় আশা এলো মনে এতটুকু ভেবে,তা ও ভালো পাখিরা নিশ্চিন্তমনে নীল আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। এখন মাটি হয়ে গেছে শত্রুসম,করোনা নাকি মাটিতে পড়ে থাকে।আকাশটাই এখন ভরসা। অই সাত আসমানে শত শত ফেরেশতা আল্লাহর ইবাদত করছেন। অই আসমান থেকেইতো রহমতের বৃষ্টি বর্ষিত হয়।মহান রাব্বুল আলামিন একমাত্র ভরসা।
যাই হউক,আব্বুর বয়স ৭০ এর উপরে আম্মুর বয়স ৬০ এর কাছাকাছি, নিজের চেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় থাকি এই দুই জনের জন্য।কিন্ত তাদের বুঝতে দেইনা। লেখার মাঝখানে ভারতের বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দ তানভীর নাসরিন তার গ্রন্থ ‘কন্ঠস্বর’ এর জন্য আমার আর আম্মুর লেখা চাইলেন,পহেলা বোশেখ সংখ্যার জন্য।আমি জানতে চাইলাম,কি নিয়ে লিখব,তিনি বললেন,তোমার ইচ্ছে।সিদ্ধান্ত নিলাম,করোনা যুদ্ধে যদি জিততে পারি তাহলে এই অবরুদ্ধ জীবনের কথাই লিখব।আর হেরে গেলে তো গেলামই। আপাকে অনুরোধ করব,এই লেখাটিই এখান থেকে কপি করে নিয়ে প্রকাশ করবেন।এরমধ্যে হোয়াটসঅ্যাপে খবর নিলেন,ভারতের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. প্রভাত কুমার দত্ত স্যার।আমাকে পরামর্শ দিলেন,আমি যেন করোনাকে ভয় না পাই।বাসায় যেন থাকি,আর আমার সুস্থতার খবর যেন দেই।স্যারকে বলেছিলাম, আমি এই করোনা নিয়ে অসুস্থ বোধ করছি।স্যার,আমাকে কন্যাসম মনে করে ভীষণ স্নেহ করেন।অথচ আমি সব সময় দুশ্চিন্তা চিন্তা করি পিতৃসম স্যারকে নিয়ে।কারন করোনা বয়স্কদের কাবু করে ফেলেন। এই এতটুকু জীবনে কত প্রাপ্তি,কত ভালবাসা অর্জন করে যখন জীবনের খাতা পূর্ণ করতে চলেছি,ঠিক সে সময় কোথা থেকে করোনা এসে সামনের সব স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার করে নেবার দায়িত্ব গ্রহন করেছে। কয়দিন আগে দেখলাম, ইতালি শহরের কোন এক লেকে মানুষের চলাচল সীমাবদ্ধ চলাচলে লেকের পানিতে মাছ ভাসছে,সাঁতার কাটছে হাঁস।দীর্ঘদিন এই লেকে মানুষ বিভিন্ন ময়লা ফেলার কারণে পানি নাকি দূষিত হয়ে মাছ ভাসা আর হাঁসের সাঁতার কাটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।আমরা হয়ত প্রকৃতির উপর মাত্রাতিরিক্ত অবিচার করে ফেলেছিলাম।তাই হয়ত সৃষ্টিকর্তা মানুষের সাথে প্রকৃতির ভারসাম্য সৃষ্টি করছেন।সৃষ্টিকর্তার ইশারা বুঝা বড় দায়। আমরা যারা নিজেদের শক্তিশালী ভাবি,অথচ প্রকৃতির কাছে কতটা অসহায় তা করোনা চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। আসুন,সৃষ্টিকর্তার বিধিবিধান মান্য করে নিজেদের ভুলের ক্ষমা চেয়ে প্রার্থনা করি।সবাই মিলে হাত তুলি। তিনি নিশ্চই ফিরিয়ে দিবেননা। কর্মচঞ্চল,সুখী সুন্দর বিশ্বের জন্য সবাই মিলে করোনা যুদ্ধে জয়ী হবার জন্য সচেতনভাবে কাজ করি।মহান সৃষ্টিকর্তা রাব্বুল আলামিন আমাদের শক্তি দিন, এই যুদ্ধে জয়ী হবার জন্য। গত ২১ মার্চ, ২০২০ইং তারিখে ‘করোনা’ নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলাম-
‘ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা বিশ্বাস করো
‘হে আল্লাহ, পাক পরোয়ারদিগার দয়ার সাগর আমাদের একমাত্র সমাধান তোমার কাছে।
তুমি আমাদের ক্ষমা করো আল্লাহ। এই বিশ্ব থেকে এই ব্যধি দূর করে দাও, মালিক তুমি।’
ওদিকে করোনার কাছে অসহায় ইতালির প্রধানমন্ত্রী কন্টি বলেছেন, আমরা মহামারীর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছি। আমরা শারীরিক ও মানসিকভাবে মারা গেছি, আর কী করতে হবে তা আমরা জানি না। পৃথিবীতে সমস্ত সমাধান শেষ হয়ে গেছে। একমাত্র সমাধান আকাশের কাছে।’
যদি আর একটি বার সুযোগ দাও, তাহলে আমাদের জীবনকে সীমিত করে ফেলব। আমাদের যতটুকু দরকার ততটুকু আয় করব। অন্যের সম্পদ দখল করবনা। এক জাতি হয়ে আর এক জাতিকে হত্যা করবনা। চাষাবাদে মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ ব্যবহার করবনা। ফলমূলে ফরমালিন মেশাবোনা। যতটুকু দরকার ততটাই আয় করব, যত্রতত্র গাছ কাটবনা। পুকুর ভরাট করবনা। দুর্নীতি করবনা, আত্মম্ভরিতা করবনা, ছিদ্রান্বেষণ করবনা। জেনে শুনে অন্যের ক্ষতি করবনা, সৃষ্টিকর্তার বিধি বিধান অমান্য করার ধৃষ্টতা দেখাবনা। যেখানে সেখানে থুতু ফেলবনা, ময়লা ফেলবনা।বিশ্বাস করো পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা, সাগরপাড় থেকে প্রবাল চুরি করবনা, সাগরে ময়লা ফেলবনা। একটি বার তুমি আমাদের সুখের দিন ফিরিয়ে দাও। হাজারবার হাজারটা জারুল,পলাশ, শিমুল ফোটার জন্য শ্রম দিব। হাঁসের সাতার কাটার জন্য পুকুর খনন করব, নিয়মমতো ঘুমিয়ে পড়ব, হালাল খাব, আর ও কত কি। ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা আমরা, আমরা, আমরা বড্ড বেশি স্বার্থপর বিপদে পড়ে রাতদিন ডাকছিহ্যা আমরা অন্ধ ছিলাম। এখন চোখের কালো পর্দা সরে গিয়ে একটি বার্তাই আসছে। নিজেকে যতটা শক্তিশালী ভাবি ততটাই অসহায় আমরা প্রকৃতির কাছে।ক্ষমা করো আমাদের হীনতা, দীনতা, সংকীর্ণতা, উচ্ছৃঙ্খলতা, উন্মাদনা, কপটতা, ছলনা।
আমাদের ক্ষমা করে দিয়ে তোমার রহমতের বৃষ্টি পৃথিবীতে বর্ষণ করো।
ড. জেবউননেছা
সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
লোকপ্রশাসন বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।