কতক্ষণ সক্রিয় থাকে করোনাভাইরাস!
বিশেষ প্রতিবেদক, প্রেসবাংলা২৪ডটকম: করোনাভাইরাসের এখনও পর্যন্ত কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। গবেষকরা বলছেন, মানবদেহ থেকে সংক্রমিত হয় করোনাভাইরাস। অর্থাৎ এটি একটি ছোঁয়াচে রোগ। সাধারণত হাঁচি-কাশি, মুখের লালা, থুতু থেকে এ ভাইরাসের সংক্রমণ হয়।
এখন প্রশ্ন উঠেছে আক্রান্ত ব্যক্তির থুতু কিংবা হাঁচি বাতাস কিংবা বস্তুর ওপর ছড়িয়ে পড়ার পর কতক্ষণ পর্যন্ত সক্রিয় থাকে করোনাভাইরাস।
আক্রান্ত ব্যক্তির থুতু-লালা-সর্দি মাটিতে কিংবা টেবিল, বইসহ ব্যবহার্য বস্তুর ওপর পড়লে সেখান থেকেও ছড়াতে পারে মরণঘাতী এ ভাইরাস। এমনকি দরজার হাতল থেকে এ ভাইরাসের সংক্রমণ বিস্তার লাভ করতে পারে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে করোনাভাইরাসকে প্রাথমিকভাবে ‘এয়ারবর্ন ভাইরাস’ বলা হচ্ছে। এয়ারবর্ন বলতে প্রাথমিকভাবে বায়ুবাহিত রোগ বোঝায়। যা মানবদেহ থেকে হাঁচি-কাশি ও কথা বলার সময় ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাক দ্বারা ছড়িয়ে পড়তে পারে।
এক্ষেত্রে বাতাসে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা কতটুকু সেটি নিয়ে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর)-সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার গণমাধ্যমকে বলেন, করোনাভাইরাসের জীবাণু অন্যান্য জীবাণু থেকে বেশ বড় ও ভারী। এজন্য হাঁচি বা কাশির সময় এটি বাতাসে বেশিক্ষণ ভেসে থাকতে পারে না। এটি নিচের দিকে পড়ে যায়। সেটি হতে পারে টেবিল কিংবা মাটিতে। এ অবস্থায় এ ভাইরাসের অস্তিত্ব কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী থাকে। আর সে সময়ের মধ্যে কেউ যদি নিজের হাত দিয়ে সে স্থান ধরেন এবং পরবর্তীতে মুখ, নাক কিংবা চোখে হাত লাগলে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন।
করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলা। যেহেতু ভাইরাসটি একদম নতুন এবং এটার ওপর গবেষণা চলছে, এজন্য এটি ঠিক কতক্ষণ বাতাসে কিংবা বস্তুর ওপর স্থায়ী থাকে সেটি বলা সম্ভব নয়। তবে গবেষণা অনুযায়ী কয়েক ঘণ্টা স্থায়ীত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলেও জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বারবার হাত ধোয়া এবং মুখে হাত না দেওয়া। সেক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে গণপরিবহনে আমরা সবাই বাসের হাতল ধরে ওঠা-নামা করি। এজন্য বাইরে থেকে এসে অবশ্যই ভালো করে হাত ধুতে হবে।
সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এক গবেষণায় জানিয়েছে, করোনাভাইরাস বাতাসে কিংবা কোন বস্তুর ওপর কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েকদিন (৪/৫) পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। একইসঙ্গে এ প্রতিবেদনে ডব্লিউএইচও গরম আবহাওয়ায় করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমে যাবে এটির গ্রহণযোগ্য প্রমাণ নেই বলেও জানিয়েছেন। অর্থাৎ সাম্প্রতিক গবেষণায় করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব গ্রীষ্মকালে কমে যাবে সেটির ভিত্তি কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
মার্চ মাসে দি জার্নাল অব হসপিটাল ইনফেকশন থেকে প্রকাশিত গবেষণা ‘বস্তুর উপর করোনাভাইরাসের বায়োলজিকাল এজেন্টের অস্তিত্বের স্থায়ীত্ব কতক্ষণ’ প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টা পর্যন্ত করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব টিকে থাকতে পারে। যেখান থেকে সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে এর বাইরে সর্বোচ্চ নয় দিন স্থায়ী হতে পারে করোনা ভাইরাস। সেক্ষেত্রে সংক্রমণের হার কম নাকি বেশি সেটি নিয়ে খোলসা করেনি এ গবেষণা। তবে হাঁচি-কাশির পর ব্যবহৃত বই, কাগজ-পত্র, দরজার হাতল, টেবিল কিংবা মাটি থেকে সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি থাকে।
প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, লস অ্যাঞ্জেলেস এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত জাতীয় ইনস্টিটিউটগুলোর বিজ্ঞানীদের এক সমীক্ষা প্রকাশিত হয় মার্চের প্রথম সপ্তাহে। সেখানে তারা বলেছেন, বাতাসে করোনাভাইরাস ছড়ানোর বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য। এ ভাইরাস বায়ুবাহিত হওয়ার পর ৩ ঘণ্টা পর্যন্ত এর অস্তিত্ব টিকে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের এনআইএইচ ইন্টার্রামাল রিসার্চ প্রোগ্রামের এক গবেষণা জানায়, নতুন কোভিড-১৯ করোনাভাইরাসটি স্টিল এবং প্লাস্টিকের ওপর সবচেয়ে দীর্ঘসময় টিকে থাকে। তাদের গবেষণায় দেখা গেছে প্লাস্টিকের কিছু খেলনার ওপর এ ভাইরাসের জীবাণু তিনদিন পর্যন্ত টিকে ছিল। পুরাতন সার্স ভাইরাসটির তুলনায় নতুন করোনাভাইরাস তিনগুণ বেশি সময় টিকে থাকে। অর্থাৎ সার্স ভাইরাস যেখানে আট ঘণ্টা পর্যন্ত টিকে থাকে সেখানে করোনাভাইরাস ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত টিকে থাকে।
তবে আশার বাণী হলো, নতুন এ গবেষণা অনুযায়ী ৩০-৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এ ভাইরাসের অস্তিত্ব সে তুলনায় অনেক কম সময় পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। তবে সর্বনিম্ন ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় করোনাভাইরাস সর্বোচ্চ ২৮ দিন পর্যন্ত জীবিত থাকতে পারে।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে তথ্য এ গবেষণা দেখিয়েছে সেটি হলো করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব কীভাবে ধ্বংস করা যাবে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, হাইড্রোজেন পারক্সাইড, ইথানল এবং সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট (রাসায়নিক ব্লিচ)-এর মিশ্রণ দ্রুত করোনাভাইরাসকে ধ্বংস করতে পারে। অর্থাৎ টেবিল, দরজার হাতল কিংবা করোনা আক্রান্ত রোগীর ব্যবহার্য বস্তুতে এ মিশ্রণ প্রয়োগ করা গেলে করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব ধ্বংস করা সম্ভব।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে আপতত ব্যক্তি সচেতনতাকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে জানাচ্ছেন গবেষকরা। ঠাণ্ডা কিংবা জ্বর হলে নিজে থেকে মাস্ক ব্যবহার করা এবং আইইডিসিআর-এ না গিয়ে হটলাইনে ফোন দিয়ে জানাতে বলেছেন আইইডিসিআর পরিচালক ডা. অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। একইসঙ্গে করোনার আশঙ্কা দেখা গেলে নিজে আইসোলেশনে থাকা। সংক্রমণ এ রোগ থেকে রেহাই পেতে যত কম সম্ভব নিজেকে বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে এবং বাইরের খাবার না খাওয়ার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন গবেষকরা।