এ রাষ্ট্র আমার না

আবু বকর সিদ্দীক, প্রেসবাংলা২৪ডটকম: ভলতেয়ারের স্বাধীন মত প্রকাশের একাগ্রতা ফারাক্কার অসময়ের পানিতে ভেড়ামারা সখিনা বিবির খড়ের ঘরের সঙ্গে ভেসে গেছে। মতের অমিল হলে তা প্রকাশের অপরাধে লাশ কাটা ঘর হবে তার বিশ্রামের জায়গা।

অক্ষমতার দায় চেপে বসেছে আমাদের মননে, লাল সবুজের পতাকা খুবলে খাচ্ছে অচেনা দস্যু। মুঠো মুঠো সোনালী রোদ্র, আমাদের মেঠোপথের সবুজ ফসল দখলে নিয়েছে দুর্বৃত্ত। সুন্দর আগামীর স্বপ্নগুলো অর্থহীন, দায় ও ক্ষমার উপহাসে অন্ধকারে মুখ লুকায়। আবরার ফাহাদের শরীরে তখনও মায়ের দোয়া, বাবার উপদেশ ছুয়ে ছিল। আদরমাখা খাবারগুলো সেদিন সকালে মায়ের হাতের শেষ আয়োজন হবে তা ভাবতে পারেনি কেউ। জাদুর শহর ঢাকায় মেধাবী তারুণ্যের পাদপীঠ বুয়েটও বোঝেনি, রাতটা কি ভয়াবহ যন্ত্রণা ও ক্ষতি বয়ে আনবে।

 

ক্রমবর্ধমান অপরাধের বিষক্রিয়া আমাদের অনুভূতিগুলোকে ভোতা করে দিয়েছে। আমরা যত্রতত্র লাশ দেখি, সংখ্যায় হিসাব করে তাদের সর্বশেষ তালিকায় চোখ বুলায়। সম্ভাবনাময় মানুষগুলোকে কালো চাঁদরে মোড়ানো বিভৎস অন্ধকার লাশে পরিণত করে, তখন কিছুই না করতে পারার অক্ষমতা ঢাকতে আমরা তা পচনের আগেই দাফন করি।

 

আবরার ফাহাদও সবাইকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলে গেছে স্থায়ী ঠিকানায়। নিরাপদ, একা। বৈষম্য আর দুর্বৃত্তায়নের চোখ রাঙানি তাকে ছুঁতে পারবে না। বুয়েটের টর্চার সেল নম্বর ২০১১ থেকে তা নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তায় ঢাকা। আমাদের বাকিটা সময়ে এভাবেই গর্তে মুখ লুকিয়ে কেটে যাবে। নির্মমতার সাক্ষী হয়ে আবরার ফাহাদের ক্ষত-বিক্ষত শরীরটা উপহাস করবে।

 

আমাদের রাজনীতির দেওলিয়াত্বের উদাহরণ আবরার হত্যা। যারা এ উন্মাত্ততায় অংশ নিয়েছে, তারাও মেধাবী, সম্ভাবনাময়। কিন্তু রাজনীতির নোংরা প্রলোভনের কাছে হেরে গেছে, ভালো-মন্দ বোঝার সক্ষমতা হারিয়েছে। এ অবক্ষয় একদিনে হয়নি, মেধাবী এসব তরুণরা শিক্ষা শেষে একটা চাকরির জন্য বোঝা হয়ে থাকে বছরের পর বছর। কিন্তু রাজনীতির পদ-পদবী থাকলে কাউকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয় না। রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়াসহ পৃথিবী হাতের মুঠোয় আনতে পারে তারা। এখানে নীতি, নৈতিকতা ও আদর্শ আক্ষরিক শব্দ ছাড়া আর কিছু না।

 

রাষ্ট্রযন্ত্রের শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে অনৈতিকতার ঘুণপোকা। সবখানে উর্দ্ধমুখী ভোগ বিলাসের দৌরাত্ম। এখানে শিকারী, বিজয়ী হওয়াই শেষ কথা। মত ও বাক স্বাধীনতার বাইরে হরিণের মতোই সবাইকে চুপসে, লুকিয়ে থাকতে হবে। হরিণেরা ইতিহাস লিখতে পারে না, ইতিহাস লেখার কলম সব সময় বিজয়ী শিকারীদের হাতেই থাকে।

 

আদিম হিংস্র মানবিকতার কেউ হয়ে আমরা সুকান্তের সঙ্গে বলতে পারি না, স্বজনহারানো শ্মশানে খুনিদের চিতা আমি তুলবোই, কেননা তাদের রক্ষার জন্য ক্ষমতার সাদা অথবা কালো বিশাল শক্ত প্রাচীল রয়েছে। বরং নিজের দেশে পরবাসী হয়ে বিঘা দুই জমির উপেনের মতোই চোর অপবাদ নিতে হয়। মুক্তচিন্তার কথা বলায় উল্টো শিবির তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল যেভাবে আবরারকে।

 

আমাদের অক্ষমতা ক্ষমার অযোগ্য, অথচ কিছুই করার নেই। বিশ্বজিতের বিচার পেতে এখন তাকেই এসে আদালতে খুনিদের দেখিয়ে দিতে হবে। কালো কাপড়ে ঢাকা বিচারিক বিবেক জাগে না, তার সামনে শিকারী ডাক্তার, পুলিশের লেখা ইতিহাস। সেখানে দেখানো হয়েছে হাসিমুখে খুনিদের বের করে দেওয়ার নানা গুপ্তপথ। একদিন, বিচার পেতে হয়তো আবরারকেও কবর থেকে উঠে আসতে হবে। ২০১১ নম্বর টর্চার সেলে ঘাতকেরা তার উপর নির্যাতন করেছে, না সে নিজেই নিজের শরীরকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে তা আদালতকে বলতে হবে। সে পর্যন্ত এ আমার এ তোমার পাপ বয়ে বেড়াতে হবে জাতিকে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক। 

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com