অস্তিত্বে প্রিয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়: ড. জেবউননেছা

ড. জেবউননেছা, প্রেসবাংলা২৪ডটকম: ওয়্যারউলফ বলেছেন,‘স্মৃতি মানে ‘গোধূলী বিকেল’ সোনালী দিনের জাবর কাটা’। সত্যিইতো জীবনের ফেলে আসার সব ঘটনাই যেন সোনালী সংস্কৃতির নকশীকাথাঁ। প্রিয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে লিখতে বসে চোখের মাঝে ভাসছে ভর্তি পরীক্ষা দেবার সেসব সোনালী স্মৃতি। সেই সোনালী দিনের যাবর কাটব লেখার মাঝে মাঝে। ১৯৯৬ সনে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ন হই। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেই। আব্বু ঢাকায় চাকুরী করতেন,বিধায় ভর্তি পরীক্ষার ফরম কেনা,জমা দেয়ার সব দায়িত্ব আব্বুই পালন করেছেন। সত্যিকার অর্থে বলা যায়,আব্বুই বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির যাবতীয় কাজ করেছেন। আমি শুধু ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছি মাত্র। মনে পড়ে,আব্বু ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে লোক প্রশাসন বিভাগে ভর্তি হবার পর বিভাগের অফিসের কর্মকর্তাদের আব্বু বলে আসেন,আমাকে যেন তারা খেয়াল রাখে। অতি আদরের সন্তান হলে যা হয়। বাবা মায়ের একমাত্র কন্যা সন্তান আমি তাই হয়ত। এখনো রোকেয়া হলের হাউসটিউটর এবং বিভাগের অফিসের সবাই আমার কথা জিজ্ঞেস করার পূর্বে আব্বুর কথা জানতে চান। আব্বুর অবদান আমার জীবনে শীতল ঝর্ণাধারার মতো। এই যে,আজ স্মৃতিকথা লিখতে বসেছি,তা ও আব্বুর দিনলিপি থেকে সাহায্য নিয়েই। কবে, কখন ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি,কবে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল বেরিয়েছে সব তথ্যই আব্বুর দিনলিপি থেকে সংগ্রহ করেছি।
মনে পড়ে, ১৯৯৬ সনে চার বোর্ডে একই সময়ে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যে কারণে, ১৯৯৬ সনকে বলা হয় ফল বিপর্যয়ের বছর। পরীক্ষ্ধাসঢ়; অনুষ্ঠিত হবার কয়দিন আগে ঘোষণা এসেছিল,অভিন্ন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকা বোর্ডে সকল বিভাগে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল ১,৭৩,৬৪০ জন। উত্তীর্ন হয় ১,১০,৭৫২ জন। প্রথম বিভাগ অর্জন করেছিল ১১,১,৩৪ জন। তন্মধ্যে মানবিক বিভাগে ২,০৫০ জন প্রথম বিভাগে উত্তীর্ন হয়। নারায়ণগঞ্জ আদর্শ বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজে মানবিক বিভাগ থেকে প্রথম বিভাগ এবং নারায়ণগঞ্জ জেলা পর্যায়ে সর্বোচ্চ সংখ্যক নম্বর পেয়েছিলাম ১৯৯৬ সনে। পাশ করার আব্বু আম্মু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, ঢাকা এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করব। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য কোচিং করিনি। অবশ্য এমনিতেও কোনদিন গৃহ শিক্ষকের কাছে পড়িনি। সেই ধারাবাহিকতায়, নিয়মিত পত্রিকা, পাঠ্যবই, ভর্তি গাইড বই অনুসরণ করতাম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আব্বু কিনে দিয়েছিলেন ‘সোনালী’ ভর্তি গাইড। আব্বু ঢাকার গুলিস্তানের জনতা ব্যাংক থেকে ৫০০ টাকা দিয়ে দুই ইউনিটের জন্য দুটি ফরম কিনেছিলেন। ২৬.৪.১৯৯৭ ইং তারিখে আব্বুর সাথে ঢাকায় এসে ফার্মগেটের ম্যাগদেলেনা মার্কেটের দোতলায় ৫০ টাকা সারচার্জ দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফরম জমা দিয়েছিলাম। ১১ এবং ১৩ মে,১৯৯৭ ইং তারিখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১১ মে, সকালে মায়ের হাতে রান্না করা খাবার টিফিনপটে নিয়ে আব্বুর সাথে সকাল ৫.৪৫ মিনিটে নারায়ণগঞ্জ থেকে রওয়ানা দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছেছিলাম ৮.৩০ মিনিটে। তখন বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতো। সেদিন পরীক্ষা ভালোই হয়েছিল এবং ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ন ও হয়েছিলাম। এই হলো ৯০ দশকে জাহাঙ্গীরনগরের সাথে ভালোবাসার সূত্রপাত। ১.৬.১৯৯৭ইং তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ন হই এবং ভর্তি হয়ে যাই। ২৩.০৬.১৯৯৭ ইং তারিখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^দ্যিালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল ‘দৈনিক জনকন্ঠ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং আমি ‘সরকার ও রাজনীতি’ বিভাগে উত্তীর্ন হই। আমার রোল নম্বর ছিল ৩৩৩৮। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগরের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়। তাই জাহাঙ্গীরনগরে ভর্তি হওয়া হয়ে উঠেনি। কিন্তু দুধের স্বাদ ঘোলে মিটেছে। নিজে পড়তে পারিনি সর্বকনিষ্ঠ ভাই জাবের বিন জালাল ২০১২ সনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪১ তম ব্যাচের পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের ১ম ব্যাচে ভর্তি হয় এবং বর্তমানে সে আকিজ গ্রুপে ‘স্বাস্থ্য কর্মকর্তা’ হিসেবে দায়িত্বপালন করছে। বিভাগ আর ছাত্রছাত্রীকে সময় দিতে গিয়ে ছোট ভাইটিকে ক্যাম্পাসে সময় দিয়েছি কম। তাই এখন আফসোস হয়। আমি রয়ে গেছি ক্যাম্পাসে। কিন্ত সে তার শিক্ষাজীবন শেষ করে চলে গেছে। আমি বোধ হয় একটু বেশী প্রফেশনাল। নইলে হাতের আঙ্গুল গুণে বলা যাবে ক্যাম্পাসে কয়বার তার সাথে দেখা হয়েছে।
কে জানত, ১৯৯৭ সালে ভর্তি পরীক্ষা দেয়া, এই আমি ২০১০ সালে লোক প্রশাসন বিভাগে শিক্ষক হবার সৌভাগ্য অর্জন করব। জীবন বড়ই বিচিত্র। আমরা কে কখন কোথায় যাব,কোথায় থাকব,তা পূর্বে থেকে কিছু জানতে পারিনা। পরবর্তীতে,লেখাপড়া শেষ করে ইউএনডিপি প্রকল্পে চাকুরী করার বদৌলতে জাহাঙ্গীরনগরের কোলঘেষে অবস্থিত বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রকল্প বাস্তবায়ন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শার্লি র্যান্ডেলের সাথে যেতাম। এরপর গণ বিশ^বিদ্যালয়ে ২০০৬ সালে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর সাড়ে তিন বছর জাহাঙ্গীরনগরের পথ সকালে পেরিয়ে যেতাম, বিকেলে ফিরে আসতাম। আসতে যেতে গাড়ী থেকে দেখতাম সবুজ বিশ্ববিদ্যালয়টিকে। ২০১০ এর বিভাগের ১ম ব্যাচ ৩৬ তম আবর্তনের শিক্ষার্থীদের পাঠদানের মধ্য দিয়ে প্রিয় জাহাঙ্গীরনগরে পথচলা শুরু হয়। এখন প্রিয় এই ক্যাম্পাস হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার বন্দরে অতন্দ্র প্রহরী হয়ে আছে।
দিনে দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরীর বয়স বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে শিক্ষার্থীদের সাথে স্নেহ শ্রদ্ধার সম্পর্ক। বিভাগের প্রতিটি শিক্ষা সফরে যাবার গুরু দায়িত্ব গ্রহণ করি। এখন পর্যন্ত কোন শিক্ষা সফর বাদ দেইনি। বিভাগের ২য় ব্যাচ ৩৭ তম আবর্তনের সাথে ভারতে শিক্ষা সফর করি। ফিরে এসে লিখেছি, ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ভ্রমণকাহিনী ‘লক্ষ্যা থেকে পিয়াসী’। স্ধেসঢ়;ই গ্রন্থের এক পর্যায়ে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে লিখেছি, ‘স্বীকার করছি তাদের খুব শাসন করি,কঠিন বকাঝকা দেই। কিন্ত অকপটে এটা স্বীকার করতে আমার দ্বিধা নেই যে, তাদেরকে আমি কতটা ভালোবাসি। হৃদয়স্থানে তাদের জন্য যে ভালোবাসা আছে। তা দেখা যায়না, যায়না স্পর্শ করা’। এজন্য আমার পুত্র আসির সবসময় অভিযোগ করে, আমি তাকে আমার ছাত্রছাত্রীদের চেয়ে তাকে কম ভালোবাসি। বলবেনা কেন,তার ৫ বছর বয়সে তাকে রেখে ভারতে শিক্ষা সফর করেছি। বিভাগের লোকাল ট্যুরগুলোতে ও তাকে নিয়ে যাইনা সঠিকভাবে দায়িত্বপালনের জন্য ।
মনে পড়ে, বিভাগের ১ম ব্যাচের একজন ছাত্র দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়। তার আর্থিক সহযোগিতার জন্য নিজেই নেমে পড়েছিলাম। এমন আরো অনেক স্মৃতি প্রিয় এই ক্যাম্পাসে। নারী দিবস,পহেলা বৈশাখ উদযাপন, ইফতার মাহফিল, বিশ্ববিদ্যালয় দিবস, নবীন বরণ, বিদায় সংবর্ধনা, খেলাধূলা কোন অনুষ্ঠান পারতপক্ষে বাদ দেইনা। অনেক সময় বিভাগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমাকেই এসকল বিষযের প্রধান হিসেবে কাজ করতে হয়েছে। বিভাগের ছাত্র কল্যাণ উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব ও পালন করেছি। তাছাড়া বিভাগের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করেছি ‘মাদক বিরোধী সচেতন ছাত্র সমাজ’ এবং ‘জেইও ষ্টুডেন্ট এসোসিয়েশন অব নারায়ণগঞ্জ’। একে একে বিভাগের বিভিন্ন ব্যাচের ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া শেষ করে বিদায় নেয়া শুরু করে। তাদের নিয়ে আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘পথের নীল ধুলো’ কাব্যগ্রন্থে ‘বিদায়ী ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে কবিতা’র শিরোনামে প্রথম কয় লাইনে লিখেছি, ‘আমার শ্রেণীকক্ষে নতুন আসে পুরনো যায়, মনের মাঝে ঠিকই পুরনোরা ও উকিঁ দিয়ে যায়।
শিক্ষক না হলে অনুভূতিতে পেতোনা এত দোলা তোমাদের কি যায় এত সহজে ভোলা?”
২০১৭ সনের ২৭.০৯.২০১৭ইং তারিখে বিভাগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি। বিভাগের সকল সম্মানিত সহকর্মীবৃন্দের সহযোগিতায় ছাত্র ছাত্রীদের জন্য এবং বিভাগের কল্যাণের জন্য যতদূর সম্ভব কাজ করার চেষ্টা করছি। প্রিয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এখন আমার জীবনে ফুলের সুভাষ ছড়িয়ে যায় সারাক্ষণ। একদিন ক্যাম্পাসটিকে না দেখলে মনে হয়, এক যুগ দেখিনা। ছাত্রছাত্রীরা আমার প্রাণ। তাদের না দেখলে ভালো লাগেনা। এ যেন আমার আর একটি সংসার। বিভাগের করিডোরে রাখা ছোট গাছগুলোর পাতা কেউ ছিঁড়লে ,আমি কষ্ট পাই। বিভাগ আমার সংসারের মত আদরের, ভালোবাসার। আমার পরিবারকে বলেছি, মৃত্যুর পর আমার লাশ যেন প্রিয় ক্যাম্পাসে নিয়ে যাওয়া হয় এবং একটি জানাযা ও যেন পড়ানো হয়। এরপর পারিবারিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যেখানে সমাহিত করতে চায়, করবে।
আজকের এই লেখার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বিনীতভাবে আবেদন করে রাখলাম। আমি শেষ যাত্রায় ছুঁয়ে যেতে চাই ভালোবাসার ক্যাম্পাসটিকে। আমাকে সেই সুযোগটি দিলে কৃতজ্ঞ থাকব।
লেখাটি লিখতে বসে আর একটি স্মৃতি মনে পড়ছে, ছোটবেলা আমার একটি শখ ছিল, নারায়ণগঞ্জের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অটোগ্রাফ নেয়া। আব্বু নারায়ণগঞ্জ জেলার ৬০ দশকের কবি ও নাট্যকার মুঃ জালাল উদ্দিন নলুয়া। আব্বু যে সকল অনুষ্ঠানে অতিথি হতেন, সে সকল অনুষ্ঠানে কতবার গিয়েছি এবং কবিতা আবৃত্তি করেছি তার হিসেব নেই। ধীরে ধীরে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা দায়িত্ব পালন করতাম। তবে যে সকল প্রোগ্রামে আব্বু অতিথি হতেন শুধু সেই অনুষ্ঠানগুলো সঞ্চালনা করতাম। এই ফাঁকে অটোগ্রাফ ও নিতাম। বিশিষ্টজনদের দোয়া আর উপদেশমাখা সেই অটোগ্রাফের ডায়েরীটি ছিল আমার প্রেরণা। অটোগ্রাফের খাতায় দেখা যায়,১৯.১০.১৯৯০ ইং তারিখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক খালেদ হোসাইন কাক্কু নারায়ণগঞ্জের একটি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন,তখন আমি কাক্কুর কাছ থেকে অটোগ্রাফ নিয়েছিলাম কাক্কু লিখেছিলেন, ‘জেবুন জীবন বড়ো মহৎ ব্যাপার। জীবনটাকে সবাই কাঙ্খিত সম্মান দান করতে পারেনা। সততা, নিষ্ঠা সম্মান, সাধনা প্রভৃতি গুণ জীবনকে মহৎ করে।
তোমার জন্য আমার আশীর্বাদ, তোমার জীবন সৌন্দর্যখচিত হউক,সার্থকতার ভাস্বর হউক তোমার জীবন।”খালেদ কাক্কুকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর যখন অটোগ্রাফটি দেখাই, কাক্কু আশ্চর্যাজনিত হয়ে পড়েন। কাক্কু জানতেনই যে, সপ্তম শ্রেণীতে পাওয়া এই উপদেশ আমার পাথেয় হয়ে ছিল আজকের এই দিনে পৌঁছাতে। কাক্কুর উপদেশ অনুযায়ী চেষ্টা করেছি, করে যাচ্ছি জীবনকে কাঙ্খিত সম্মান দান করতে।জানিনা কতটুকু পেরেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর যেদিন কাক্কুর সাথে দেখা করতে যাই, সেদিন আব্বু সাথে ছিলেন। সেদিন আমি আবদার করেই কাক্কুকে বলে ফেললাম,আমি কিন্ত আপনাকে কিন্তু কাক্কুই বলব। কাক্কু ও আমাকে অনেক স্নেহ করেন এবং ‘আম্মু’ বলে সম্বোধন করেন। কাক্কুর সাথে আব্বুর সাহিত্যিক জগতের বন্ধুতা পাঁচ দশকের উপর। কাক্কু , আব্বুকে সাহিত্য জগতের বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে যথেষ্ঠ সম্মান করেন। কাক্কুর চোখের সামনেই বড় হলাম। উল্লেখ্য, সাহিত্য জগতে আব্বুর সকল বন্ধু এবং সাহিত্য শিষ্যকে আমি কাক্কু বলে সম্বোধন করি সেই ছোটবেলা থেকে। ক্যাম্পাসটিতে আমার অভিবাবক হিসেবে আছেন যেমন খালেদ কাক্কু , তেমনি আছেন নারায়ণগঞ্জের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সালাহউদ্দিন আহমেদ কাকা, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এস এম শাহনেওয়াজ কাকা।
উল্লেখ্য, এই তিনজন অধ্যাপক নারায়ণগঞ্জবাসী এবং আব্বুর পূর্ব পরিচিত বলে আমি কাকা বলেই সম্বোধন করি। ক্যাম্পাসটির পাশে বিপিএটিসি স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ নাসিম ফারুক স্যার যিনি এই বিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১তম আবর্তনের ছাত্র ছিলেন। নারায়ণগঞ্জে আমি যেই কলেজে পড়েছি সেই কলেজে তিনি ২০০১ থেকে ২০০৭ সন পর্যন্ত অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি আছেন অভিবাবকের মত ছায়া হয়ে । এজন্য ক্যাম্পাসকে কখনও আমার অভিবাবকহীন মনে হয়না। মনে হয় এই ক্যাম্পাসে আমি একা নই। ভুল করলে ভুল ধরিয়ে দেবার মত যেমন অভিবাবক আছেন,তেমনি স্নেহ করার মতন ও কেউ কেউ আছেন। এ যেন আত্মার সম্পর্ক। এছাড়া, আমার সকল বয়োজ্যেষ্ঠ ও বয়োকনিষ্ঠ সহকর্মীবৃন্দের সাথে রয়েছে অনন্য সম্পর্ক। এ যেন এক পরিবার। এ পরিবারের সম্মান মানে আমার সম্মান। এ পরিবারকে উঁচুতে রাখার দায়িত্ব আমার এবং সকলের। এত সুন্দর সবুজ ক্যাম্পাস পৃথিবীর আর কোথাও আছে কিনা জানা নেই।
আমি সব সময় সকল বক্তব্যে সুযোগ পেলেই ক্যাম্পাসটিকে ‘সাংস্কৃতিক রাজধানী’ বলে থাকি। প্রাণের এই ক্যাম্পাস মাথা তুলে বাংলাদেশ নয় বিশ্বের দরবারে উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠিত হউক এই প্রার্থনা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আমার অহংকার। আমার পেশাগত জীবনের অলংকার। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে শিক্ষকতা নামক মহানুভব পেশায় দায়িত্ব পালন করার সুযোগ করে দিয়েছে বলে আমি অবনত মস্তকে শ্রদ্ধা জানাই। ২০০৪ এ এমএসএস এ পরীক্ষায় উত্তীর্ন হই এবং ২০১০ এ সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করি। মধ্যখানে চাকুরী করি চারটি প্রতিষ্ঠানে। তবু হৃদয়ে দাগ কেটেছে প্রিয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। একটি বার, এক সেকেন্ডের জন্য মনে হয়না, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলামনা বলে আমার ক্যাম্পাসটির প্রতি ভালোবাসা কম। বরং অকপট চিত্তে বলতে পারি, যতটুকু ভালোবাসলে আর ভালোবাসা যায়না, ততটুকুই ভালোবাসি প্রিয় ক্যাম্পাসটিকে। এই ভালোবাসা দেখানো যায়না,অনুভবের বিষয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিলে ঝিলের প্রজাপতি, শাপলা, অতিথি পাখি, শ্রাবণের বৃষ্টি,রোদেলা দুপুর সবই যেন মন কেঁড়ে নেয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি মিশে গেছে আমার অস্তিত্বে। আমার অনুভবে, খেয়ালে, বেখেয়ালে, ধ্যাণ- ধারণায় আমি প্রিয় ক্যাম্পাসকে অন্তরে ধারণ করি। আমার ছাত্রছাত্রী আমার সন্তানের মতই আদরের। তারা মেধায় শাণিত হয়ে জাহাঙ্গীরনগরকে এগিয়ে নিয়ে যাক এই প্রার্থনা। হাতে হাত ধরে প্রিয় ক্যাম্পাসে সবাই কাজ করব এই প্রত্যাশা রইল।
আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘পথের নীলধুলো’তে প্রকাশিত ‘সবুজের রানী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়’ শিরোনামের কবিতা দিয়ে লেখাটি শেষ করব-,
প্রিয় জাবি মনের অজান্তে বড্ড বেশি ভালোবেসেছি তোমায়
তোমার রূপে আমি মুগ্ধ।
তুমি অকাতরে সবুজ গাছ, রঙিন ফুল দিয়ে
নিজেকে সাজিয়েছ সবুজের রাণী করে।
প্রিয় জাবি
মনের অজান্তে বড্ড বেশি ভালোবাসি কেন জানো?
তোমার বুকে বেড়ে উঠা কৃষ্ণচুড়া, জারুল ফুলের
প্রেমে আমি অন্ধ।
তোমার বুকে গজিয়ে উঠা দুর্বা ঘাসের
সাদাফুল আমাকে করে পুলকিত।
শুভ্র সকালে শিউলী ফুলে সেজে থাকো তুমি
পথের মাঝে শিউলীকে রাখো বিছিয়ে।
প্রিয় জাবি
ভালোবাসার কোন বৃত্ত নেই আমি জানি বলে
তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কোন বৃত্তের চক্রে আবদ্ধ নয়।
তোমাকে হৃদয় দিয়ে হৃদয় অনুভব করে ভালোবেসে ফেলেছি বেশী
বিনিময়ে কিছু চাওয়ার নেই
চাই শুধু
এভাবেই আজন্ম শাপলা,পদ্ম,প্রজাপতি নিয়ে
তুমি রূপসী হয়ে বেচেঁ থাকো’।