বাংলাদেশে প্রতিদিন দুই হাজার করে পাট থেকে সোনালী পলিথিন উৎপাদন

 

প্রেসবাংলা২৪ডটকম: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রচণ্ডতার মধ্যে অপচনশীল প্লাস্টিক বর্জ্য নিয়ে বিশ্ব যখন উদ্বিগ্ন, সেই সময়ে পরিবেশবান্ধব বিকল্প ব্যাগ উদ্ভাবন করে বিশ্বকে আশার আলো দেখিয়েছেন একজন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী। বিকল্প সেই ব্যাগটি দেখতে প্লাস্টিকের ব্যাগের মতো হলেও তা তৈরি করা হয়েছে পাট দিয়ে। পরীক্ষামূলকভাবে বাংলাদেশ এখন প্রতিদিন দুই হাজার করে পাটজাত পলিথিন উৎপাদন করছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘সোনালি ব্যাগ’।

মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) এই ব্যাগের উদ্ভাবন, উৎপাদন ও সম্ভাবনার কথা উঠে এসেছে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স-এর এক প্রতিবেদনে।

.
পাট উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এখানে ভারতের পর সবচেয়ে বেশি পাট উৎপাদিত হলেও চাহিদা কমে যাওয়ায় একসময়ের ‘সোনালী আঁশ’খ্যাত এই শিল্প তার গৌরব হারিয়ে ফেলেছিল। তবে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি)-এর বিজ্ঞানবিষয়ক উপদেষ্টা মোবারক আহমদ খান পাট দিয়ে পচনশীল পলিব্যাগ আবিষ্কারের পর নতুন করে সম্ভাবনাময় হয়ে উঠেছে পাটশিল্প।

 

পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটজাত পচনশীল সোনালি ব্যাগ তৈরির প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয় ২০১৭ সালের ১২ মে। বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের (বিজেএমসি)তত্ত্বাবধানে পাটের তৈরি সোনালি ব্যাগ উদ্ভাবন করা হয়। উদ্ভাবিত সোনালি ব্যাগ পাইলট প্রকল্প পর্যায়ে উৎপাদনের উদ্যোগ নেয় বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত প্রতিষ্ঠান বিজেএমসি। রাজধানীর ডেমরায় অবস্থিত লতিফ বাওয়ানী জুটমিলে সোনালি ব্যাগ তৈরির প্রাথমিক পাইলট প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়।

 

অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত স্বার্থে সোনালি ব্যাগের ব্যবহার বিস্তৃত করার কাজ দ্রুততর করার জন্য গত মার্চে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রকল্পে কার্যরতদের প্রতি আহ্বান জানান। এ বছরের এপ্রিলে পাট থেকে পলিথিনের ব্যাগ উৎপাদনে অধিকতর গবেষণার জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীন জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড থেকে ৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। বিজেএমসি’র মহাব্যবস্থাপক মামুনুর রশিদ রয়টার্সকে বলেন, ‘এ প্রকল্পটি পুরোদমে বাস্তবায়িত হতে শুরু করলে ছয় মাসের মধ্যে আমরা বাণিজ্যিকভাবে সোনালি ব্যাগ উৎপাদন করতে সক্ষম হবো আশা করি।’

 

২০০২ সালে প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ। যদিও সে নিষেধাজ্ঞা খুব একটা সফল হয়নি। উদ্ভাবক মোবারক আহমেদ খান জানান, বর্তমানে চীন থেকে শুরু করে ফ্রান্স পর্যন্ত ৬০টির বেশি দেশে আংশিকভাবে হলেও পলিথিনের ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা বিস্তৃত হওয়ায় শতাধিক বাংলাদেশি ও আন্তর্জাতিক ফার্ম নতুন পাটভিত্তিক শপিং ব্যাগ ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছে। তিনি বলেন ‘প্রতিদিনই আমি ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মেক্সিকো, জাপান ও ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশের ক্রেতাদের কাছ থেকে ইমেইল ও ফোন কল পাচ্ছি।’ মোবারক খান রয়টার্সকে জানান, তিন মাস মাটিতে পুঁতে রাখলে ব্যাগগুলো পচে যাবে। এ পলিথিনগুলোকে নতুন করে ব্যবহারের উপযোগী করেও তোলা যায়।

 

ঢাকাভিত্তিক রফতানি ফার্ম ইকো বাংলা জুট লিমিটেডের পরিচালক সবুজ হোসেন আশা প্রকাশ করেছেন, বিশ্বজুড়ে এই ব্যাগের ‘বিপুল চাহিদা’ তৈরি হবে। তিনি জানান, তার কোম্পানি ধীরে ধীরে প্রতি মাসে ১ কোটি ব্যাগ রফতানির সম্ভাবনা দেখছে।

 

বিজেএমসি’র মহাব্যবস্থাপক মামুনুর রশিদ বলেন, ‘এ বছরের শেষ নাগাদ সোনালি ব্যাগের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হবে বলে আশা করছি।’ আর উদ্ভাবক মোবারক খান জানান, বাংলাদেশে উৎপাদিত সব পাট দিয়েও যদি সোনালি ব্যাগ তৈরি করা হয়, তারপরও দেশের মাত্র এক তৃতীয়াংশ চাহিদা পূরণ করা যাবে।

 

বাংলাদেশে প্রায় দুই দশক আগে প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হলেও বিকল্পের অভাবে ও সীমিত কড়াকড়ির কারণে এখানে এখনও প্রতি বছর কোটি কোটি ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, প্রতি মাসে ঢাকায়ব্যবহার করা হয়  প্রায় ৪১ কোটি ব্যাগ। বুড়িগঙ্গা নদীর মতো কিছু জলপথে তিন মিটার পর্যন্ত বর্জিত পলি ব্যাগের স্তর জমা হয়েছে। পরিবেশ অধিদফতরের উপ মহাপরিচালক কাজী সারওয়ার ইমতিয়াজ হাশমি আশা করছেন, পরিবেশ সংকট কমাতে এ ব্যাগগুলো সহায়ক হতে পারে। তিনি বলেন, ‘পাটের তৈরি পলিমার ব্যাগ পুরোপুরি পচনশীল এবং তা পরিবেশ দূষণ মোকাবিলায় সহায়ক হবে।’

 

পচনশীল ও পরিবেশবান্ধব ব্যাগ তৈরির উদ্দেশ্যে পাট থেকে সেলুলোজ আহরণ করা হয়। ওই সেলুলোজকে প্রক্রিয়াজাত করে অন্যান্য পরিবেশবান্ধব দ্রব্যাদির মাধ্যমে কম্পোজিট করে তৈরি করা হয় সোনালি ব্যাগ। উৎপাদিত ব্যাগে ৫০ শতাংশের বেশিরভাগ সেলুলোজ বিদ্যমান। তাছাড়া এতে অন্য কোনও প্রকার অপচনশীল দ্রব্য ব্যবহার হয় না বলে এটি দুই থেকে তিন মাসের মধ্যেই সম্পূর্ণরূপে মাটির সঙ্গে মিশে যায়।

 

আবিষ্কৃত এই ব্যাগের ভার বহন ক্ষমতা পলিথিনের প্রায় দেড়গুণ এবং এটি পলিথিনের মতোই স্বচ্ছ হওয়ায় খাদ্য দ্রব্যাদি ও গার্মেন্টস শিল্পের প্যাকেজিং হিসেবে ব্যবহারের খুবই উপযোগী। তাছাড়া দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহার করায় এই ব্যাগের দাম প্রচলিত পলিথিন ব্যাগের কাছাকাছিই থাকবে। তাছাড়া এই ধরনের প্যাকেজিংয়ের বিদেশেও অত্যন্ত চাহিদা রয়েছে।

 

বিশ্বজুড়ে প্লাস্টিক পদার্থের নিয়মিত ব্যবহার প্লাস্টিক দূষণের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। অপাচ্য এ পদার্থ পরিবেশে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করছে। খাল-বিল, নদী-নালা থেকে শুরু করে মহাসমুদ্র পর্যন্ত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে প্লাস্টিক পদার্থ ও প্লাস্টিক কণা । এই পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে বিশ্বের সব স্তরের জীববৈচিত্র্য মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। একইসঙ্গে খাদ্য চেইনের মাধ্যমে অন্যান্য প্রাণীসহ জনস্বাস্থ্যও এখন মারাত্মক হুমকিতে রয়েছে। তবে পাট থেকে আবিষ্কৃত পচনশীল পলিব্যাগ এসব সমস্যা সমাধানে কার্যকরি ভূমিকা রাখতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com